অনলাইন ডেস্ক: পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম ও স্থায়ী সম্পর্ক যেসব ক্ষেত্রে গড়ে ওঠে, তার মধ্যে মা-বাবা ও সন্তানের মধ্যকার সম্পর্ক অন্যতম। এ সম্পর্ক জন্মগত, যা অস্তিত্বের মাঝে বিরাজমান। মানুষ যত দিন তার অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকবে, তত দিন সে তার মধ্যে স্বীয় মা-বাবার নমুনা বহন করবে। সন্তান পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখার বহু আগে থেকেই মা-বাবার দেহে অবস্থান করে।
সন্তান জন্মের সাথে সাথে মা-বাবার প্রতি প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু হক কার্যকর হতে শুরু করে এবং তখন থেকেই সেই হক অনুযায়ী আমল করা মা-বাবার কর্তব্য হয়ে যায়। মা-বাবার প্রতি সন্তানের হক হচ্ছে প্রথমত তিনটি। ১. জন্মের পরপরই তার একটি সুন্দর ধর্মীয় নাম রাখতে হবে। ২. জ্ঞান বুদ্ধি বাড়লে তাকে কুরআন তথা ইসলাম সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে। ৩. আর সে যখন পূর্ণ বয়স্ক হবে, তখন তার বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। বস্তুত সন্তানের ভালো একটি নাম না রাখা, কুরআন ও ইসলামের শিক্ষা না দেয়া এবং প্রাপ্তবয়স্ক হলে তার বিয়ের ব্যবস্থা না করা মা-বাবার অপরাধের মধ্যে গণ্য। এসব কাজ না করলে মা-বাবার পারিবারিক দায়িত্ব পালিত হতে পারে না। ভবিষ্যৎ সমাজও ইসলামী আদর্শ মোতাবেক গড়ে উঠতে পারে না।
অনুরূপভাবে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সপ্তম দিনে আকিকা করাও মা-বাবার দায়িত্ব। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, নবী করিম সা: সপ্তম দিনে সন্তানের নাম রাখতে, মস্তক মুণ্ডন করতে এবং আকিকা করতে আদেশ দিয়েছেন (তিরমিজি শরিফ)।
আজকাল অনেক মুসলমানের সন্তানের নাম শুনে বোঝার উপায় নেই যে, সে মুসলিম কি না? একজন মুসলমানের নাম শুনেই বোঝা যাবে যে সে একজন মুসলমান। চাল-চলনে, ওঠা-বসায়, কথাবার্তায় তথা সব ক্ষেত্রেই একজন মুসলমান অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে। জীবনের সব ক্ষেত্রেই সে হবে সুন্নাতে নবীর মূর্ত প্রতীক। মা-বাবা যদি সন্তানের হক সঠিকভাবে আদায় করে তার সুন্দর একটি নাম নির্বাচন করে ইসলাম ও দ্বীন শিক্ষা দেয়, সঠিক সময়ে বিয়ের ব্যবস্থা করে তাহলে ওই সন্তান কখনো মা-বাবার কষ্টের কারণ হতে পারে না। বরং সে হবে মা-বাবার চোখের শীতলতা।
আল কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আর যারা বলে হে আমাদের রব, আপনি আমাদের এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন, যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে। আর আপনি আমাদের মুত্তাকিনদের ইমাম বানিয়ে দিন’ (সূরা ফুরকান, আয়াত ৭৪)।
সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তার ডান কানে আজান ও বাম কানে ইকামত বলাও মা-বাবার দায়িত্ব। হজরত আবু রাফে রা: বলেন, হজরত ফাতেমা রা: যখন হুসাইন রা:-কে প্রসব করলেন তখন নবী করিম সা:-কে তাঁর কানে নামাজের আজান শুনাতে আমি দেখেছি (আবু দাউদ)। এখানে একটি বিষয়ের প্রতি উলামায়ে কেরাম ইঙ্গিত দিয়েছেন। তা হলো ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় আজান-ইকামত দেয়া হলো, এখন নামাজ পড়ার পালা। অর্থাৎ মানুষের জন্ম হওয়াটাই যেন নামাজের উদ্দেশ্যে। তাই তো হাদিস শরিফে সাত বছর বয়স থেকেই নামাজের আদেশ করা হয়েছে। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, তোমরা তোমাদের সন্তান-সন্ততিদের নামাজ পড়তে আদেশ করো। যখন তারা সাত বছর বয়সে পৌঁছবে এবং নামাজের জন্য তাদের প্রহার করো (শাসন করো)। যখন তারা ১০ বছরে উপনীত হবে, আর তখন তাদের জন্য পৃথক শয্যার ব্যবস্থা করাও তোমাদের কর্তব্য (আবু দাউদ)।
মা-বাবা হিসেবে সন্তানের প্রতি সবচেয়ে বড় যে দায়িত্ব, তা হলো তাওহিদ বা একত্ববাদের আদর্শে সন্তানের জীবনের ভিত্তি গড়ে তোলা। এ প্রসঙ্গে কুরআন মাজিদে উল্লিখিত হজরত লোকমান আ:-এর নছিহত তার পুত্রের প্রতি বিশেষভাবে স্মরণীয়। ইরশাদ হচ্ছে, হে প্রিয় পুত্র! আল্লাহর সাথে শিরক করো না, কেননা শিরক হচ্ছে অত্যন্ত বড় জুলুম (সূরা লোকমান, আয়াত ১৩)।
মা-বাবার ওপর সন্তানের জন্য যেমন কিছু করণীয় দায়িত্ব রয়েছে অনুরূপভাবে সন্তানের ওপরও মাতা-পিতার জন্য অবশ্য করণীয় কিছু দায়িত্ব আছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, তোমার প্রতিপালক আদেশ করেন তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত না করতে এবং মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তাদের একজন অথবা উভয়জন তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে উফ (বিরক্তি ক্রোধ অথবা ঘৃণাসূচক) বলো না এবং তাদের ধমক দিও না। তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বলবে।
মমতাবেশে তাদের প্রতি নম্রতার ডানা অবনত করবে এবং বলবে, হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি রহমত নাজিল করো যেভাবে তারা আমাকে শৈশবে লালন-পালন করেছে (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ২৩-২৪)। উল্লিখিত আয়াতে প্রথমে আল্লাহকে এক ও লা-শারিক বলে স্বীকার করার নির্দেশ এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সামান্যতম বন্দেগি করতেও স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করা হয়েছে। তার সাথে সাথে নির্দেশ দেয়া হয়েছে মা-বাবার সাথে ভালো ব্যবহার করার। এ দু’টি নির্দেশ একসঙ্গে দেয়ার অর্থ এই যে, প্রতিপালনের ক্ষেত্রে আল্লাহ ও মা-বাবার বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ অনুগ্রহ রয়েছে। প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা ও লালন-পালনকারী তো মহান আল্লাহ। সুতরাং বান্দাহর ওপর সর্ব প্রথম হক তারই ধার্য হবে। কিন্তু আল্লাহ যেহেতু এ কাজ সরাসরি নিজে করেন না, বরং মা-বাবার মাধ্যমে করিয়ে নেন, তাই বান্দাহর ওপর আল্লাহর হকের পরপরই মা-বাবার হক ধার্য হবে। মা-বাবার মাধ্যমে শৈশবে সন্তানের প্রতি যে দরদ-মায়া ও ভালোবাসাপূর্ণ আচরণ প্রকাশ পায়, সেই আচরণের কথা স্মরণ করে দিয়ে মহান আল্লাহ মা-বাবার প্রতি রহমত কামনা করতে নির্দেশ দিচ্ছেন। মা-বাবার জন্য মহান আল্লাহ সরাসরি দোয়া করার নির্দেশ দিয়ে তাদের সম্মান যে কত উঁচু সে দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।
সেই সাথে সন্তানের উচিত তার শৈশবের অসহায়ত্বের কথা স্মরণ করা। শৈশবে সে যখন ছিল অসহায়, নিজে নিজে কোনো কাজই সে করতে পারত না, তখন যেমন মা-বাবা তাকে হাত ধরে ধরে সব কাজ শিখিয়েছেন, তার সুখের জন্য তার আরামের জন্য নিজের সুখ-শান্তিকে বিসর্জন দিয়েছেন, সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়লে মা-বাবা অস্থির হয়ে উঠতেন। এ সবকিছু সন্তানের প্রতি মা-বাবার দরদ ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালোবাসাপূর্ণ মধুময় সম্পর্ক হলো মা-বাবা ও সন্তানের মধ্যকার সম্পর্ক যে মা-বাবার মধ্যে সন্তানের জন্য এত দয়া, এত মায়া সেই মা-বাবাকে যিনি সৃষ্টি করেছেন, সেই আল্লাহ কত দয়ালু তার বান্দার প্রতি সে দিকে বান্দাহর খেয়াল করা দরকার।
তাই তো হজরত লোকমান আ: তার সন্তানের প্রতি প্রথম নির্দেশ দিচ্ছেন, হে বৎস! শিরক করো না, অবশ্যই শিরক মস্তবড় জুলুম। শিরক যেমন কবিরা গোনাহ, অনুরূপভাবে মা-বাবার নাফরমানি করাও কবিরা গোনাহ। তবে মা-বাবার আনুগত্য করতে গিয়ে আল্লাহর নাফরমানি করা কোনোক্রমেই বৈধ হবে না। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে রাসূল সা: ইরশাদ করেন, খালেকের নাফরমানি করে মাখলুকের ফরমাবরদারি করা যাবে না (মুসনাদে আহমদ)।
রাসূলুল্লাহ সা: কবিরা গোনাহ কী কী তা বলতে গিয়ে শিরক করা ও মা-বাবার নাফরমানি করাকে একসাথে উল্লেখ করেছেন। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে আল্লাহর সাথে শিরক করা এবং মা-বাবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা সবচেয়ে বড় কবিরা গোনাহ (বুখারি)।
হজরত জাহেমা রা: বলেন, আমি রাসূল সা:-এর কাছে জিহাদে শরিক হওয়া সম্পর্কে পরামর্শ করার জন্য উপস্থিত হলাম। তখন রাসূল সা: জিজ্ঞেস করলেন তোমার মা কি জীবিত আছেন? আমি বললাম, হ্যাঁ। তখন রাসূল সা: বললেন, তুমি ফিরে যাও এবং তোমার মায়ের সম্মান ও খেদমত করতে থাক। কেননা তার পায়ের নিচেই তোমার জান্নাত (নাসাঈ)।
আজ সমাজে মা-বাবা ও সন্তানের পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে আমরা একেবারেই উদাসীন। দুনিয়ার মোহে পড়ে আমরা সর্বদা ইসলামের বিধানগুলো জলাঞ্জলি দিচ্ছি। আধুনিকতার বিষবাষ্পে আমরা সন্তানদের ইসলামী ভাবধারা থেকে দূরে ঠেলে দিয়ে দুনিয়ামুখী করে গড়ে তুলছি। এ কারণেই তো আমাদের সন্তানেরা মা-বাবাকে একপর্যায়ে বোঝা মনে করে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। তাই বৃদ্ধ মা-বাবার শেষ আশ্রয় এখন হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে।
হজরত আয়েশা সিদ্দীকা রা: বর্ণনা করেন, একদা নবী করিম সা: ওসামার (শিশু অবস্থায়) মুখ ধুয়ে দিতে বলেন। আমি মুখ ধুতে লাগলাম, কিন্তু এটা আমার ভালো লাগছিল না। রাসূলুল্লাহ সা: তা বুঝতে পারলেন। তৎক্ষণাৎ তিনি আমার হাত থেকে ওসামাকে নিয়ে নিজেই তার মুখ ধুয়ে দেন। এরপর তাকে চুম্বন করেন এবং বললেন, তার জন্য নির্দিষ্ট কোনো কাজের মেয়ে না থাকাই তো আমরা এ সুযোগটি পেয়েছি। সুতরাং এটি নিঃসন্দেহে আমাদের প্রতি ওসামার এহসান।
ইবনে মাজা শরিফে বর্ণিত আছে, এক ব্যক্তি রাসূলে আকরাম সা:-এর খেদমতে হাজির হয়ে প্রশ্ন করল, সন্তানের ওপর মা-বাবার কী কী অধিকার রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, তোমার মা-বাবা তোমার জান্নাত অথবা জাহান্নাম।
হাদিসে আরো বর্ণিত হয়েছে, একদা এক লোক প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল সা:, আমার সেবা ও সদ্ব্যবহারের সর্বাপেক্ষা বেশি হকদার কে? রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, তোমার মা। লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল তারপর কে? বললেন তোমার মা, লোকটি আবারো জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন তোমার মা। এরপর তোমার বাবা তোমার সেবা ও উত্তম ব্যবহারের হকদার (বোখারি ও মুসলিম)।
হাদিসে আরো বর্ণিত আছে আল্লাহর সন্তুষ্টি মা-বাবার সন্তুষ্টির মধ্যে নিহিত রয়েছে। অনুরূপ মা-বাবাকে অসন্তুষ্ট করলে আল্লাহ তায়ালা অসন্তুষ্ট হন (ইবনে হেব্বান)।
এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সা:-এর খেদমতে হাজির হয়ে আরজ করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার মা-বাবার ইন্তেকালের পরে তাদের জন্য আমার কী হক পালন করতে হবে? তিনি বললেন, তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে মাগফিরাতের দোয়া করো। তাদের সাথে তোমার কৃত ওয়াদা এবং তাদের কৃত অসিয়ত পালন করো। তাদের বন্ধু-বান্ধবদের সম্মান করো। তাই আমাদের সন্তানদের সঠিক ইসলামী শিক্ষা দিয়ে আমরা যেন তাদের কাছ থেকে ইসলামী নিয়মে সম্মান ও মর্যাদা পাই, সে জন্য আমাদের সচেতন হতে হবে।
লেখক : ইমাম
Leave a Reply