ঈদে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার – ছবি : সংগ্রহ
সারা মাস রোজার পর আসে ঈদ। এই ঈদকে ঘিরে কত আনন্দভাবনা, কত প্রস্তুতি আমাদের সবার। কিন্তু ঈদে শারীরিকভাবে সুস্থ না থাকলে সব আনন্দই মাটি হয়ে যাবে। সুস্থ শরীর সুস্থ মন। ঈদ মানেই খুশি, ঈদ মানেই আনন্দ। ঈদের এ খুশি এ আনন্দকে প্রাণভরে উপভোগ করার জন্য যত পারো খাও- এ ধরনের একটি মানসিকতা কাজ করে ঈদের দিন সবার মধ্যেই। লিখেছেন অধ্যাপিকা ডা: ওয়ানাইজা রহমান
অনেকেই ভেবে থাকেন, যেহেতু বছরে এ একটাই তো মাত্র ঈদের দিন, তাই এ একটা দিনে বেশি বেশি খেলে এমন কী ক্ষতি হবে? কিন্তু একটা কথা মনে রাখা উচিত এ একটা দিনই আপনাকে অনেক দিন ভোগাতে পারে যদি আপনি খাবার গ্রহণে সতর্ক না হন।
ঈদের আনন্দটাই অন্য রকম। মিষ্টি, গোশত, বিভিন্ন ধরনের পানীয় প্রভৃতি খাবারে এ দিনটাকে যেন স্মরণীয় করে রাখা। ঈদের দিন সকালবেলা সব বাড়িতেই মিষ্টি খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। অতিথি এলে প্রথমেই মিষ্টি দেয়া হয়। নিজেরাও বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি খাবার মুখে দিয়ে ঈদের দিনটি শুরু করেন। সত্যিকার অর্থে ঈদে মিষ্টি খাওয়ার রেওয়াজ থাকলেও এটা যতদূর সম্ভব সীমিত রাখাই ভালো। যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, ওজন বেশি কিংবা ওজন বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে তারা ঈদের দিন মিষ্টি খাবেন না। ঈদের দিন অনেক খাবারে বাড়তি চিনি মেশানো হয়। এটা উচিত নয়। বাড়তি চিনি ক্যালরি বাড়ায়। স্বাস্থ্যের জন্য এটা মঙ্গলজনক নয়। তবে মিষ্টির বিকল্প হিসেবে দই খাওয়া যেতে পারে। দইয়ে রয়েছে উপকারী ব্যাকটেরিয়া, কম চিনি এবং কম ক্যালরি। সকালবেলা খুব কম মিষ্টির পাশাপাশি চটপটি, নুডুলস প্রভৃতি খাবার গ্রহণ করা যেতে পারে।
চর্বি নিয়ে ভাবুন
প্রত্যেক মানুষের রক্তে নির্দিষ্ট মাত্রায় চর্বি থাকে। এ চর্বির পরিমাণ বেড়ে গেলে স্বাস্থ্যের জন্য তা মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। রক্তে অতিরিক্ত মাত্রার চর্বি করোনারি হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। রক্তে কিংবা শরীরের চর্বি কমানোর সহজ উপায় হলো গরু বা খাসির গোশত কম খাওয়া।
ঈদের দিন সব বাড়িতেই কম বেশি গোশত রান্না হয়। গরু, খাসি কিংবা মুরগি একটা-না-একটা গোশত থাকবেই। তবে বেশির ভাগ বাড়িতে গরু ও খাসির গোশত প্রাধান্য পায়। গরু ও খাসির গোশতে থাকে প্রচুর চর্বি। বয়স্ক লোকের জন্য এ চর্বি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। চর্বিতে থাকে ক্ষতিকর কোলেস্টরল। এটা হৃৎপিণ্ডের চিরচেনা শত্রু। যারা করোনারি হৃদরোগে ভুগছেন, ঈদের চর্বিসমৃদ্ধ গোশত তাদের বিপদ ডেকে আনে। যারা হৃদরোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ তাদের এ সময়ে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা মারাত্মক আকারে বেড়ে যায়। তাই ঈদে গোশত রান্না করতে হবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখে।
গোশত রান্নার আগে গোশত থেকে চর্বি কেটে বাদ দিয়ে কিংবা গোশতকে আগুনে কিছুটা ঝলসে নিয়ে তারপর রান্না করলে অবাঞ্ছিত চর্বি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। গোশতে ভালোমতো হলুদ মেখে কিছুক্ষণ ফ্রিজে রাখলেও চর্বির পরিমাণ কমবে। গোশতে হলুদ মেশালে আরেকটি উপকার পাওয়া যায়। হলুদ হলো ব্যাকটেরিয়াবিরোধী এক প্রাকৃতিক উপাদান। এটি খাবারের মধ্যে অবস্থিত বিষাক্ত ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে।
ক্ষতিকর চর্বি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কলিজা ও মগজ পরিহার করতে হবে। রান্নার কাজে ঘি, বাটারঅয়েল প্রভৃতি ব্যবহার না করে সয়াবিন কিংবা সূর্যমুখীর তেল ব্যবহার করাই উত্তম। এতে বাড়তি চর্বির ঝুঁকি থাকবে না। সর্বদা উদ্ভিজ তেল এবং মাছের তেলকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। অনেকে রান্নার কাজে অলিভঅয়েল ব্যবহার করেন। এটা অবশ্যই স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। অলিভঅয়েল বৃহদন্ত্রের ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
যাদের গরু কিংবা খাসির গোশতে বিধিনিষেধ রয়েছে তারা এ দিনে মুরগির গোশত খেতে পারেন। তবে মুরগির গোশত রান্না করার আগে চামড়াটা ফেলে দিতে হবে, কারণ একটা মুরগিতে যে পরিমাণ চর্বি থাকে তার অর্ধেকটাই আসে চামড়া থেকে। একই সাথে কলিজা আর মগজ ফেলে দিতে হবে। ডিমের তৈরি খাবার থেকে কুসুম বাদ দিতে হবে।
গোশত রান্নার সময় তাতে পিঁয়াজ ও রসুন বেশি দেবেন। অনেকের ধারণা, পিঁয়াজ ও রসুন খাদ্যের ঘ্রাণ ও স্বাদ বাড়ানো ছাড়া অন্য কোনো কাজ করে না। কিন্তু চিকিৎসকেরা বলছেন, পিঁয়াজে রয়েছে হৃদযন্ত্র ও রক্তনালীর জন্য উপকারী ফ্লেভোনয়েডস আর রসুনে রয়েছে পলিফেনলজাতীয় রাসায়নিক উপাদান যা হৃদরোগ প্রতিহত করে শরীর সুস্থ রাখে।
সালাদের ওপর গুরুত্ব দিন
ঈদের দিন সালাদ খাওয়া নিয়ে কার্পণ্য করবেন না বরং অন্য খাবার কমিয়ে দিয়ে পেটটা ভরে তোলার চেষ্টা করুন স্রেফ সালাদ দিয়ে। সালাদ হিসেবে গাজর, টমেটো, শসা ও লেটুস অনন্য। মূলজাতীয় সবজির মধ্যে গাজরে রয়েছে সর্বোচ্চ পরিমাণ বিটা ক্যারোটিন। লেটুসেও রয়েছে প্রচুর পরিমাণ বিটা ক্যারোটিন। টমেটোতে রয়েছে লাইপোকেন নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। তবে কাঁচা টমেটোর চেয়ে রান্না করা টমেটো উত্তম। সালাদের সাথে সয়া যোগ করুন। সয়া বা সয়াদ্রব্যে থাকে ফাইটোইস্ট্রোজেন নামক উপাদান যা প্রোস্টেট এবং স্তন ক্যান্সারকে প্রতিরোধ করে। আর সালাদ সব সময় টাটকা খাবেন।
গতানুগতিকতা পরিহার করুন
বাঙালিমাত্রই ভোজনরসিক। যেকোনো উপলক্ষে বিশাল ভোজন এক সামাজিক রীতি। তবে ঈদে ভোজনের প্রচলিত ধারাটি পরিহার করুন। পোলাও কিংবা বিরিয়ানির পরিবর্তে খিচুড়ি পরিবেশন করুন। খিচুড়ি অনেক বেশি স্বাস্থ্যসম্মত। ঈদের দিন খিচুড়ি একটু বেমানান দেখালেও একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে নিজের ও পরিবারের উপকারটাই করবেন। মনে রাখবেন, খিচুড়ি একটি আদর্শ খাবার এবং যেকোনো উৎসবে এটা পরিবেশনযোগ্য।
বুঝে নিন পেটের অবস্থা
ঈদের দিন হঠাৎ করে উল্টাপাল্টা খাওয়াতে পেট ফাঁপতে পারে, দেখা দিতে পারে পেটের পীড়া। যারা পেপটিক আলসারে ভুগছেন তাদের পেটে তীব্র ব্যথা হতে পারে। অনেকের পাতলা পায়খানা, পেট কামড়ানো, বারবার পায়খানাসহ বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এ দিনে তাই বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন।
সৌজন্য রক্ষার খাতিরে এক সাথে অনেক বাসাবাড়িতে দাওয়াত খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
খাদ্যে ঝাল যেন বেশি না হয় সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে।
গোশত খাবার পর দুধজাতীয় খাবার খাওয়া যাবে না।
যাদের দুধে অসহনিয়তা রয়েছে তারা দুধজাতীয় খাবার পরিহার করবেন।
পোলাও কিংবা বিরিয়ানি না খেয়ে পোলাওয়ের চাল দিয়ে রান্না করা সাদাভাত খেতে পারেন।
কখনো পুরোপুরি পেটপুরে খাবেন না কিংবা অতিরিক্ত খাবেন না। প্রয়োজনে কোমরের বেল্ট শক্ত করে বেঁধে নেবেন যাতে অতিমাত্রায় খেলে বুঝতে পারেন।
চিকিৎসাগত সতর্কতা নিন
ঈদের দিন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়াটা বিচিত্র কিছু নয়। কিছু কিছু ওষুধ এ সময় হাতের কাছে রাখা প্রয়োজন। তবে যে ওষুধই গ্রহণ করুন না কেন তা চিকিৎসকের পরামর্শ মতো গ্রহণ করবেন।
বমি বমি ভাব বা বমির জন্য মেটোক্রোপ্রামাইড অথবা ডমপেরিডন জাতীয় ওষুধ।
হঠাৎ পেট ব্যথা কিংবা পেট কামড়ালে হায়োসিন বিউটাইল ব্রমাইড কিংবা ড্রটাভেরিন জাতীয় ওষুধ।
পেট ফাঁপা কিংবা পেপটিক আলসারের সমস্যার জন্য অ্যান্টাসিড ও রেনিটিডিন জাতীয় ওষুধ।
মাথাব্যথার জন্য প্যারাসিটামল।
পাতলা পায়খানার জন্য খাবার স্যালাইন।
এবার আসা যাক পোশাক প্রসঙ্গে। বড়দের ব্যাপারে হয়তো বা কোনো সমস্যা নেই। এবার ঈদে আবহাওয়া খুব ভালো থাকারই সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু শিশুদের পোশাকের ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। ঈদের আনন্দে ফ্যাশনসচেতন বাবা-মা অনেক সময় ছোট শিশুদের এমন পোশাক পরান যা কি না আরামদায়ক নয়। বরং শিশুর জন্য অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। বেশি টাইট বা গরম জামা পরলে ত্বকে প্রদাহ বা র্যাশ হতে পারে। আবার ঈদের পোশাকে যদি শিশু বেশি গরম বোধ করে ও ঘামে তাহলে এতে ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। অবশ্যই শিশুর জন্য আরামদায়ক পোশাক নির্বাচন করবেন।
ঈদের সাজে নতুন কোনো প্রসাধনী ব্যবহারের আগে মহিলারা সাবধানতা অবলম্বন করুন। নতুন কিছু ব্যবহারে হঠাৎ করে ত্বকের সমস্যা দেখা দিতে পারে। নতুন প্রসাধনী মুখে ব্যবহারের আগে পরীক্ষা করুন। হাতে বা কপালে আগে লাগিয়ে দেখুন কোনো সমস্যা হয় কি না। সমস্যা না হলে ব্যবহার করুন। দামি বা বিদেশী প্রসাধনী হলেই সেটা ভালো হবে আপনার জন্য এমন কোনো কথা নয়। যেটা আপনার ত্বকের উপযোগী এমন প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহার করবেন।
আজকাল অনেক রকম ধাতুর গয়না এসেছে। যেকোনো গয়না ব্যবহারের পর ত্বকে প্রদাহ, চুলকানি বা অন্য কোনো সমস্যা হলেই সেই গয়না খুলে রাখবেন। Allergic Contact Dermatitis বা সংস্পর্শজনিত ত্বকের প্রদাহ গয়না থেকে হতে পারে।
আশা করি, আপনাদের ঈদ আনন্দে কাটবে। যদি কোনো শারীরিক সমস্যা হয় তবে নিকটবর্তী হাসপাতালে যোগাযোগ করবেন। হাসপাতালগুলোতে ঈদের ছুটিতেও কিন্তু চিকিৎসক থাকেন। আর আপনার নিজস্ব চিকিৎসকের ফোন নাম্বার থাকলে সম্ভব হলে তার সাথে যোগাযোগ করবেন। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।
লেখিকা : অধ্যাপিকা, ফার্মাকলোজি ও থেরাপিউটিকস বিভাগ, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ।
Leave a Reply