বাংলাদেশের টেকনাফ বর্ডার দিয়ে মাদক হিসেবে ইয়াবা প্রথম প্রবেশ করে ১৯৯৭ সালে। ইয়াবা হলো মেথাফেটামাইন ও ক্যাফেইনের মিশ্রণ। মাদকটি একাধারে মস্তিষ্ক ও হূদ্যন্ত্র আক্রমণ করে। এর পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জার্মান প্রেসিডেন্ট এডলফ হিটলার তার মেডিকেল চিফকে আদেশ দিলেন দীর্ঘ সময় ব্যাপি যুদ্ধক্ষেত্রের সেনাদের যাতে ক্লান্তি না আসে এবং উদ্দীপনায় যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে বা বিমানের পাইলটের নিদ্রাহীনতা, মনকে উৎফুল, চাঙ্গা রাখার জন্য একটা কিছু আবিস্কার করতে।
টানা ৫ মাস রসায়নবিদগণ চেষ্টা চালিয়ে মিথাইল অ্যামফিটামিন ও ক্যাফেইনের সংমিশ্রনে তৈরি করলেন ইয়াবা। ব্যাস! হিটলারের উদ্দেশ্য সফল। সেনারা মানসিক শক্তিতে বলিয়ান হল।
ইয়াবা আসলে কী জিনিস
এর মূল শব্দ থাই থেকে উত্পত্তি। সংক্ষিপ্ত অর্থ পাগলা ওষুধ। অনেকে একে বলে ‘ক্রেজি মেডিসিন‘। মূল উপাদান মেথঅ্যামফিটামিন। আসলে ইয়াবা নেশা জাতীয় ওষুধ। এক ভয়াবহ মাদক যা মস্তিষ্ক, হূদযন্ত্র এবং শরীরের যে কোনো অঙ্গকেই আক্রান্ত করতে পারে। ধীরে ধীরে অকেজো করে দেয় একটি সুন্দর দেহ, মন ও মানসিকতার। ইয়াবা আসক্তির কারণে মস্তিষ্কের বিকৃতি হতে পারে। মাঝে মাঝে ইয়াবার সঙ্গে ক্যাফেইন বা হেরোইন মেশানো হয়, যা আরও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এটি এক সময় সর্দি ও নাক বন্ধ হয়ে যাওয়ার ওষুধ হিসেবে ব্যবহূত হতো কোনো কোনো দেশে। আরো ব্যবহার করা হতো ওজন কমানোর ওষুধ হিসাবে। পরবর্তী সময়ে সাধারণ মানুষ বিশেষত শিক্ষার্থী, দীর্ঘ যাত্রার গাড়ি চালক ও দৌড়বিদরা এটি ব্যবহার শুরু করেন। ধীরে ধীরে এর কুফল বা দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া উদঘাটিত হতে থাকায় বিশ্বব্যাপী এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির সেনাদের নিদ্রা, ক্ষুধা ও ক্লান্তিহীন করার জন্য ইয়াবা জাতীয় ওষুধ খাওয়ানো হতো। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ক্লন্তি দূর করতে ও সজাগ থাকতে সেনাদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল মেথঅ্যামফিটামিন। সেনারা হতো হিংশ্র, ক্লান্তিহীন ও আগ্রাসী। কিন্তু একবার আসক্ত হয়ে যুদ্ধ ফেরত সেনারা মানসিক অবসাদ গ্রস্ততায় ভুগত এবং আরও হিংশ্র হয়ে উঠত। এক সেনা আরেক সেনাকে গুলি করে মারত, আবার কখনো নিজে আত্মহত্যা করত।
তরুণ প্রজন্ম যে একটু একটু করে হলেও মাদকতার নিষিদ্ধ জগতে হাত বাড়িয়েছে, তা আজ আর কারও অজানা নেই। ঐশীর জীবনের ভয়াবহ পরিণতি আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে, আমাদের ইয়াবা রুপী মাদকতার বিষাক্ত ছোবল কতটা ভয়াবহ। ইয়াবা নামের ছোট্ট ট্যাবলেটটি দেখতে অনেকটা ক্যান্ডির মতো, স্বাদেও তেমনি মজাদার। তরুণ তরুণীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে মূল উপাদানের সঙ্গে মেশানো হয় আঙুর, কমলা বা ভ্যানিলার ফ্লেভার, সবুজ বা লাল কমলা রঙ। ফলে আসক্ত ব্যক্তিরা এর প্রচন্ড ক্ষতিকর প্রভাবটুকু প্রথমে বুঝতে পারে না। একই কারণে এটি পরিবহন করা ও লুকিয়ে রাখাও সহজ।
ইয়াবার আনন্দ আর উত্তেজনা আসক্ত ব্যক্তিদের সাময়িকভাবে ভুলিয়ে দেয় জীবনের সব যন্ত্রণা। তারা বাস করে স্বপ্নের এক জগতে। এই ভয়ানক মাদক সেবন করলে মনে উত্ফুল্ল ভাব তৈরি হয়, মুড হাই হয়ে যায়। ইয়াবা ট্যাবলেট খেলে সেক্স কি বাড়ে? এমনকি ইয়াবার প্রচন্ড উত্তেজক ক্ষমতা আছে বলে যৌন উত্তেজক হিসেবে অনেকে ব্যবহার করে এটি। এতে যৌন উত্তেজনা বেড়ে যায়, মনে উত্তেজনা আসে। তাই অনেক যুবক যুবতীরা কৌতূহল বশত ইয়াবা সেবন করে থাকে।
ক্ষুধা কমিয়ে দেয় বলে স্লিম হওয়ার ওষুধ হিসেবে অনেকে শুরু করে ইয়াবা সেবন। কিছুটা ওজন কমে। ঘুম কমিয়ে দেয়, সারা রাতের পার্টির আগে ক্লান্তিহীন উপভোগ নিশ্চিত করতে অনেকের পছন্দ ইয়াবা। তবে সবগুলোই সাময়িক। কিন্তু সাময়িক আনন্দের এই ভয়ানক ট্যাবলেটটি যে তাদের ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে, তা টের পাওয়ারও অবকাশ সে সময় তাদের আর থাকে না।
দেখা যায়, কিছুদিন ইয়াবা সেবনের পর শুরু হয় এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। কৌতূহল বশত: কয়েকদিন সেবনের পরই আসক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, এটি ছেড়ে দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন ইয়াবা ছাড়া আর কিছুই ভালো লাগে না। ওই মাদক পেতে যে কোনো হীন অপকর্ম করতেও হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। প্রথমে কম ডোজে এ ট্যাবলেট কাজ করলেও ধীরে ধীরে ডোজ বাড়াতে হয়। আগে যে পরিমাণ ইয়াবা আনন্দ এনে দিত, পরে তাতে আর হয় না। বাড়তে থাকে ট্যাবলেটের পরিমাণ, ক্ষণস্থায়ী আনন্দের পর বাড়তে থাকে ক্ষতিকর নানা উপসর্গও।
প্রথমেই শুরু হয় মানসিক অবসাদ গ্রস্থতা। শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়তে থাকে, মেজাজ হয় খিটখিটে, গলা মুখ শুকিয়ে আসতে থাকে, অনবরত প্রচন্ড ঘাম আর গরমের অসহ্য অনুভূতি বাড়তে থাকে। বাড়ে নাড়ির গতি, রক্তচাপ, দেহের তাপমাত্রা আর শ্বাস প্রশ্বাসের গতি। দেহে আসে মানসিক অবসাদ, ঘুম না হওয়া এবং চিন্তা ও আচরণে বৈকল্য দেখা দেয়। মানুষ আর মানুষ থাকে না। হয়ে উঠে হিংশ্র, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। ন্যায় অন্যায় বোধ লোপ পায়। হয়ে উঠে অপরাধ প্রবণ। অনায়াসে মানুষ খুন করতেও দিদ্ধা বোধ করেনা। এক সময়ে শরীরের অন্যান্য অঙ্গও অকেজো হয়ে যায়।
ইয়াবা সেবিরা উচ্চ রক্তচাপে ভোগে
দীর্ঘদিনের আসক্ত ব্যক্তিরা উচ্চ রক্তচাপে ভোগে। মস্তিষ্কের ভেতরকার ছোট রক্তনালিগুলো ক্ষয় হতে থাকে, এগুলো ছিঁড়ে অনেকের রক্তক্ষরণ শুরু হয়। স্মৃতিশক্তি কমে যায়, মানসিক নানা রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, অহেতুক রাগারাগি, ভাংচুরের প্রবণতা বাড়ে। পড়াশোনা, কর্মক্ষেত্র বা পারিবারিক জীবনে বিরূপ প্রভাব পড়ে। সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থতা বা পিছিয়ে পড়তে থাকায় আসক্ত ব্যক্তিরা বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়। কারও কারও মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়। দৃষ্টি বিভ্রম, শ্রুতি বিভ্রম আর অস্বাভাবিক সন্দেহ প্রভৃতি উপসর্গ থেকে এক সময় জটিল মানসিক ব্যধিও দেখা দেয়। বেশি পরিমাণে নেওয়া ইয়াবা সেবনের ফলে শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রমের ব্যত্যয় ঘটিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে।
সামগ্রিক দৃষ্টিতে ইয়াবা সেবনের ক্ষতি অসীম ও অপূরণীয়ও এটি পরিবারকে ধ্বংস করে। সমাজকে করে কলুষিত এবং দেশকে করে পঙ্গু। পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পরে। রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়। এই মাদক জীবন থেকে জীবন এবং হূদয়ের আবেগ অনুভুতি কেড়ে নেয়। আলোর পথ ছেড়ে নিয়ে যায় অন্ধকার পথে। স্বাধীন হূদয় পরিণত হয় নেশার দাসে। ইয়াবার পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি আসক্ত ব্যক্তিরা এর ওপর শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। একবার ইয়াবা নেওয়ার কয়েক ঘণ্টা বা নির্দিষ্ট সময় পর আবার না নিলে শরীরে ও মনে নানা উপসর্গ দেখা দেয়। ফলে বাধ্য হয়ে আসক্ত ব্যক্তিরা আবার ফিরে যায় নেশার জগতে।
ইয়াবার প্রতিকার ও প্রতিরোধ
ইয়াবা আসক্তি প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ করা অনেক সহজ। সুতরাং প্রতিরোধের উপর বেশি মনোযোগ দিতে হবে। এই মাদকের আগ্রাসন থেকে দেশের যুব সমাজকে রক্ষা করতে প্রয়োজন সামগ্রিক প্রতিরোধ। আসক্ত ব্যক্তি, যিনি পুনরায় স্বাভাবিক সুস্থ জীবন ফিরে পেতে চায়, তাদের নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। এ কথা মোটেই সত্য নয় যে, তারা আর কখনোই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে না। শুধু মাত্র প্রয়োজন ধৈর্য সহকারে দীর্ঘমেয়াদি চিকিত্সা।
একবার কেউ আসক্ত হয়ে গেলে তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার না করে ভালোভাবে বোঝাতে হবে, যাকে বলে কাউন্সেলিং। কোনক্রমেই বকাবকি, তালাবদ্ধ করে রাখা যাবে না। চিকিত্সার জন্য রাজি করিয়ে তার শারীরিক বিভিন্ন সমস্যার চিকিত্সার পাশাপাশি মানসিক চিকিত্সার জন্য মনোরোগ চিকিত্সকের পরামর্শ নেওয়া জরুরী। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে বিভিন্ন ধরনের চিকিত্সা পদ্ধতি আসক্ত ব্যক্তিদের আশার আলো দেখাচ্ছে। তারা ফিরে যেতে পারছে মাদকমুক্ত জীবনধারায়।
ওষুধ, সাইকোথেরাপি ও অন্যান্য উপায়ে মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবনযাপন পদ্ধতিতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হয় তার আগের পারিপার্শিক পরিবেশ, যা তাকে মাদকাসক্ত হতে উদ্ধুদ্ধ করেছিল। এতে মানসিক রোগ চিকিত্সক ও মনোবিজ্ঞানীর যেমন ভূমিকা রয়েছে, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে পরিবার, আত্মীয়স্বজন আর প্রকৃত ভালো বন্ধুরও।
একজন নেশাসক্ত ব্যক্তি সবার সম্মিলিত সহযোগিতায়ই আবার ফিরে পেতে পারে মাদকমুক্ত সুস্থ জীবন। আর প্রতিরোধ একক ভাবে কোনো ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ বা দেশের পক্ষে করা সম্ভব নয়। সবাইকে নিয়েই এই প্রতিরোধ যুদ্ধে নামতে হবে এবং এই যুদ্ধ চলমান রাখতে হবে। গড়ে তুলতে হবে মাদক প্রতিরোধ সামাজিক আন্দোলন।দৃঢ় পারিবারিক বন্ধন ও সঠিক শিক্ষা মাদক প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রথমেই এসব দায়িত্ব বর্তায় পরিবারের উপর।
আর সমাজ ও দেশের দায়িত্ব মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে ঘৃণা ও অপরাধী হিসেবে বড় করে না দেখে কোথা থেকে, কীভাবে, কারা মাদক সরবরাহকারী বা কারা এসবের মূল হোতা, তাদের বিচার ও শাস্তির আওতায় আনা। তবেই এই ভয়ানক ইয়াবার ছোবল থেকে আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্ম ও কোমলমতি সন্তানদের রক্ষা করা সম্ভব হবে। তাই এখনই উচিত সবাইকে একতাবদ্ধ হয়ে মাদক বিরোধী স্লোগানে সোচ্চার হওয়া। মনে রাখতে হবে অপরাধী নয়, অপরাধই ঘৃণার বিষয়। স্বাভাবিক সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে তাদের প্রতি ঘৃণা নয়, বরং সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
অধ্যাপক ডাঃ এ বি এম আব্দুল্লাহ
লেখক:ডীন, মেডিসিন অনুষদ অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
পিবিএ/এমএস
Leave a Reply