তাসলিমা বেগম রেনু। বয়স ৪০। এক ছেলে এক মেয়ে জননী। বড় ছেলে মাহিনের বয়স ১১ আর ছোট মেয়ে তুবা তাসনিমের বয়স চার বছর। আড়াই বছর আগে রেনুর বিবাহবিচ্ছেদ হয়। এরপর থেকেই এই দুই সন্তানকে নিয়ে তার জীবন যুদ্ধের পথচলা। সন্তানদের নিজের বুকে আগলে রেখে মানুষ করার জন্য তিনি আড়ং ও ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। আত্মীয়স্বজনরা আমেরিকায় থাকায় তারও সামনের বছর যাওয়ার কথা ছিল। সেই প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন রেনু। ছোট মেয়ে তুবা বাসায় একটু বেশি দুষ্টামি করায় তাকে স্কুলে ভর্তি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় রেনু।
সে কারণে মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করানোর তথ্য সংগ্রহে গত শনিবার সকালে গুলশানের উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঢুকে পড়েন রেনু। কিন্তু সেই তথ্যই নেয়াই তার জীবনের জন্য কাল হয়ে গেল। মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করানো আর আমেরিকা যাওয়ার স্বপ্ন তার পূরণ হলো না। তার আগেই তাকে ছেলেধরা গুজবের বলি হতে হলো। কিছু অতিউৎসাহী প্রকাশ্যেই পিটিয়ে হত্যা করল রেনুকে।
এ ঘটনায় গত শনিবার রাতে বাড্ডা থানায় একটি হত্যা মামলা করা হয়। মামলায় অজ্ঞাত ৪০০-৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। নির্মম এ হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় কয়েকজন যুবককে শনাক্ত করেছে পুলিশ। স্কুলের দোতলা থেকে করা একটি মোবাইলের ভিডিও দেখে তাদের শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের নাম-পরিচয় ও বিস্তারিত জানার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তবে এ ঘটনায় এ খবর লেখা পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এ দিকে ঘটনাস্থলে ধারণকৃত একটি মোবাইলের ফুটেজে দেখা যায়, নিহত রেনুকে প্রধান শিক্ষকের রুম থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করার পর মুহূর্তেই লোক জড়ো হয়ে তাকে ঘিরে ফেলে। তবে স্থানীয় চার-পাঁচ যুবক তাকে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছিল ও এলোপাতাড়ি লাথি মারছিল। ভিডিওর ৩-৪ মিনিটের মধ্যেই সে অচেতন হয়ে পড়ে। এরপর পুলিশ তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন। স্কুলের অভিভাবকেরা জানান, অনেকে ভিড় করলেও স্থানীয় তিন-চার যুবকই মূলত তাকে মারধর করে হত্যা করেছে। অন্যরা পেছন থেকে ‘মার, মার’ চিৎকার করছিল।
পুলিশের বাড্ডা জোনের এডিসি আহমেদ হুমায়ূন সাংবাদিকদের বলেন, আমরা ঘটনাস্থল থেকে সিসিটিভি ক্যামেরা ও মোবাইলে ধারণকৃত কিছু ফুটেজ যাচাই-বাছাই করছি। অনেকের সাথে কথা বলা হয়েছে। এ পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। তবে মামলা যেহেতু হয়েছে, জড়িতদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনা হবেই।
তাসলিমা বেগম রেনুর পরিবার জানিয়েছে, আমেরিকায় যাওয়ার জন্য তার সব কাগজপত্র প্রস্তুত ছিল। ইতোমধ্যে সে গ্রিনকার্ড পেয়েছিল। সামনে বছর সে চলে যাওয়ার কথা ছিল। তার বড় ভাই বিষয়টির সব কিছু সম্পন্নও করে রেখেছিলেন। এ দিকে তার ছোট মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাবেন। প্রাথমিক শিক্ষার কিছুটা হাতেখড়ি নিয়ে মেয়েকে সাথে নিয়ে পাড়ি জমাবেন সুদূর আমেরিকায়। তারপর সেখানে মেয়েকে একটি স্কুলে ভর্তি করাবেন। এসব স্বপ্ন নিয়েই বেঁচে ছিলেন তাসলিমা। তাসলিমার এভাবে চলে যাওয়ায় দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ কি হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তবে তাসলিমাকে এমনভাবে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার বিচার চান তার পরিবার। এ হত্যায় জড়িতদের দ্রুত বের করে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছে তারা।
তার ভাগিনা সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু বলেন, বিনা অপরাধে একজন মানুষকে এভাবে পিটিয়ে মারা কতটা যৌক্তিক? সে ছেলেধরা কি না তা যাচাই করার দায়িত্ব তো পুলিশের। তারা কেন তাকে পিটিয়ে হত্যা করবে? এ কাজ তো কোনো বিবেকবান মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়।
নিহতের বড় বোন নাজমা আক্তার বলেন, এভাবে কি একজন শিক্ষিত মানুষকে পিটিয়ে মারা সম্ভব! আমরা এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। যারা আমার বোনকে পিটিয়ে মেরেছে তাদের ফাঁসি চাই। আর যেন কোনো মানুষকে কেউ এভাবে পিটিয়ে হত্যা না করতে পারে। একজন মানুষতো তার সন্তানকে স্কুলে ভর্তির জন্য যেতেই পারে। শিক্ষকদের সাথে কথা বলতেই পারে। তার জন্য কি তাকে ছেলেধরা ভেবে পিটিয়ে মারতে হবে! আমরা এর বিচার চাই। এখন তার সন্তানদের কি হবে, কে দেবে তাদের মায়ের মমতা। কাকে তারা আম্মু বলে ডাকবে, কাকেই বা জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে। এমন কথাগুলো বলেই তিনি কান্নায় জড়িয়ে পড়েন।
তিনি জানান, তারা পাঁচ বোন ও এক ভাই। তাসলিমার দুই বছর আগে তার স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়। তাসলিমা রাজধানীর টিএনটি কলেজ থেকে এইচএসসি ও সরকারি তিতুমীর কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করেন। তার ছোট মেয়ে তাসনিমকে অন্য স্কুলে পড়াবেন না। তার ইচ্ছে ছিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর একটিতে পড়ানো। এ বিষয়ে সপ্তাহ খানেক আগেই তাসলিমার সাথে বড় বোন নাজমার কথাও হয়। তখন তাসলিমা জানিয়েছিল, ছোট মেয়েকে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তির জন্য এক দিন সে কোনো একটি স্কুলে গিয়ে বিষয়টি জেনে আসবে। কিন্তু সেই বিষয়টি জানতে গিয়ে আর বাসায় ফেরা হলো না তাসলিমার।
গত শনিবারের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মামলার বাদী ও রেনুর ভাগনে নাসির উদ্দিন বলেন, খালার আচরণ সন্দেহ হওয়ায় নাকি স্কুলের বাইরে থেকে হট্টগোল শুরু হয়। ৩-৪ মিনিটের মধ্যে পুরো মানুষে ভরে যায়। এ সময় স্কুলের মাঠে থাকা অভিভাবকদের সন্দেহ হলে তারা খালাকে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে নিয়ে যায়। পরে ছেলেধরা গুজব ছড়িয়ে পড়লে স্কুলের আশপাশের লোকজন জড়ো হয়। এ সময় দোতলায় থাকা প্রধান শিক্ষকের রুম থেকে খালাকে টেনে-হেঁচড়ে নিচে নামিয়ে গণপিটুনি দেয়া হয়। তিনি বলেন, শুধু সন্দেহেরবশে মানুষ মানুষকে হত্যা করে? বাস্তবতা না দেখেই একটা কথা শুনে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আমরা কোথায় আছি? বলে প্রশ্ন রাখেন তিনি।
Leave a Reply