নববাগঞ্জ (দিনাজপুর) থেকে এম রুহুল আমিন প্রধান
২০১৭ সাল। উপজেলা মৎস সপ্তাহ উদযাপন উপলক্ষ্যে সংবাদকমর্ীদের নিয়ে মত বিনিময় ডেকেছিলেন সেসময়ের উপজেলা মৎস কর্মকর্তা শামীম আহমেদ। আশুরার বিলের সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোকপাত করেন মৎস কর্মকর্তা। তিনি জানান, উত্তর জনপদের দেশীয় প্রজাতির মাছ চাষের ব্যপক সম্ভাবনার স্থান আশুরার বিল। মতবিনিময় সভায় সেসময় প্রথম আলোর বিরামপুর উপজেলা প্রতিনিধি প্রভাষক এ এস এম আলমগীর জানান, বিলের মাঝে কচুরীপানা সহ বাঁশের খুঁটি দিয়ে আলাদা আলাদা প্লট করে মাছ চাষ করে মৎস চাষীরা। অথচ বিলটি সবসময় থাকবে উন্মুক্ত। ওই জলাশয় থেকে মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করবে মৎস চাষীরা। সেখানে আইল দিয়ে দখলের পায়তারা কেন? এমন জিজ্ঞাসা গণমাধ্যম কর্মী আলমগীরের। ওই বৈঠক থেকেই সরাসরি উপজেলা নির্বাহী অফিসার কে জানানো হলেও তেমন সুফল পাওয়া যায়নি। এরপর মোঃ মশিউর রহমান উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সেসময় নবাবগঞ্জ উপজেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি এম রুহুল আমিন প্রধান, সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান সহ বিলের অবৈধ স্থাপনা সহ কচুরীপানা অপসারণের জন্য ইউএনওকে জানানো হলে তিনি শুক্রবার বন্ধের দিনে আশুড়ার বিলে কচুরিপানা পরিষ্কার ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে বিলে নেমে পড়লেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মশিউর রহমান। শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত নবাবগঞ্জের ঐতিহাসিক আশুড়ার বিলে এ অভিযান চালান তিনি।এক সময়ের লাল-সাদা শাপলা ও পদ্ময় ভরপর দৃষ্টিনন্দন বিলটি অবৈধ দখলদারদের দাপটে হারিয়ে ফেলেছে সৌন্দর্য। বাঁশের বেড়া আর কচুরিপানা দিয়ে বিলটি ভরে গেছে। তাই বিল পরিষ্কার ও দখলদারদের হাত থেকে আশুড়ার বিলকে উদ্ধারের জন্য সপ্তাহজুড়ে নির্দেশ দিচ্ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মশিউর রহমান । তিনি যেভাবে চাইছিলেন ঠিক সেভাবে কাজটি হচ্ছিল না। তাই শুক্রবার নিজেই নেমে পড়লেন বিলে। এক টানা সাড়ে তিন ঘণ্টা বিলের কাদাপানিতে থেকে পরিষ্কার করলেন কচুরিপানা। উচ্ছেদ করলেন অবৈধ স্থাপনাসমূহ। উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে বিলে নামতে দেখে স্থানীয় জনসাধারণসহ রাজনৈতিক নেতারাও নেমে পড়েন বিলে। তারাও যোগ দেন পরিষ্কারের পরিচ্ছন্নতার কাজে। নবাবগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা জানান, ৩৬০ হেক্টর এলাকাজুড়ে আশুরা বিল। এখানে দেশীয় মাছ লাল খলশে, কাকিলা, ধেধলসহ বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির বিভিন্ন মাছ পাওয়া যায়। অভিযানে অংশ নেয়া নবাবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান জানান, একজন ইউএনও বিলের কাদাপানিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা থেকে কচুরিপানা পরিষ্কার, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করবেন তা স্বপ্নেও ভাবিনি।
তিনি বলেন, ঐতিহ্যবাহী বিলটি এক সময় উত্তরাঞ্চলের ভ্রমণপিপাসুদর অন্যতম দর্শনীয় স্থান ছিল। দখলদারদের কারণে বিলটি ঐতিহ্য হারিয়েছে। এটি রক্ষার দায়িত্ব স্থানীয় লোকজনের ছিল। ইউএনও মশিউর রহমানের ব্যতিক্রমী অভিযান তাদের চোখ খুলে দিয়েছে । উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মশিউর রহমান বলেন, জাতীয় উদ্যানের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া এ বিলটি দেশের অমূল্য সম্পদ। এক সময় এ বিলজুড়ে ফুটত লাল-সাদা শাপলা ও পদ্ম ফুল। শীতে অতিথি পাখিরা আসত। পাখির কলরবে মুখরিত থাকত এই এলাকা। কিন্তু দীর্ঘদিন থেকে এক দল প্রভাবশালী বিলটি দখলে নিয়েছিল। বিলটিকে বাঁশের বেড়া, মাচা দিয়ে অসংখ্য ভাগে ভাগ করে ফেলেছিল। কচুরিপানায় ভরে গিয়েছিল পুরো বিল। হারিয়ে গেছে শাপলা, পদ্ম ফুল। শীতকালে ধান চাষ করায় ফসলে কীটনাশক ব্যবহারে হারিয়ে গেছে বহু দেশি প্রজাতির মাছ। অতিথি পাখি আর আসে না। এরপর অতিথি পাখিদের নিরাপদ রাখতে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নির্দেশে সেসময়ের দিনাজপুর সামাজিক বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা নিশিকান্ত মালাকারের মাধ্যমে বেশ কিছু মাটির হাঁাড়ি গাছে গাছে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। এরপর বিলের কচুরীপানা অপসারণের পরে ইউএনও শাপলা সহ শোভাবর্ধনের বিভিন্ন জাতের ফুলের চারা বন বিভাগের মাধ্যমে রোপনের কাজ শুরু করেন।
কাঠের সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা
বিলের পর্যটকদের আগমন ঘটাতে ও বিলকে দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তুলতে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে শালবন পর্যন্ত আঁকাবঁাকা কাঠের সেতু নির্মানের প্রস্তাব রাখেন এ এস এম আলমগীর। অর্থ বরাদ্দ এক টাকাও নেই। কি করে সম্ভব? সাহসীকতার কাছে কোনভাবেই হার মানলেন না উপজেলা নির্বাহী অফিসার। আমার জানা আছে আলমগীর কাজটি শুরুর জন্য ৫০হাজার টাকা কর্য দিয়েছিল। এ অর্থেই হাতে খড়ি। আঁকাবঁাকা সেতুটি করতে চায়নি সেসময়ের সরকারি ২ কর্মকর্তা। বন্ধ ছিল পরিকল্পনার ফাইল এক মাস। এরপর শুরু হল কাঠ ক্রয় করে সেতু নির্মাণের কাজ। স্থানীয় তানভীর আহমেদ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধীকারী শ্রমিক নেতা মোঃ মতিবুর রহমান কে সেতুটি নির্মানের দায়িত্ব ভার দেয়া হয়। দীর্ঘ সময় ধরে শেষ করে সেতু নির্মানের কাজ। এরপর আনুষ্ঠানিক ভাবে সেতুটি উদ্ভোধনের উদ্যোগ গ্রহন করে উপজেলা প্রশাসন। এরপর স্থানীয় সংসদ সদস্য মোঃ শিবলী সাদিক এর নির্দেশে সেতুটির নাম দেয়া হয় শেখ ফজিলাতুন্নেছা কাঠের সেতু। ঘটা করে রং বার্ণিশ শেষে উদ্ভোধন করা হয়। প্রধান অতিথি হিসেবে উদ্ভোধন করেন সংসদ সদস্য মোঃ শিবলী সাদিক। এসময় দিনাজপুর জেলা প্রশাসক মোঃ মাহমুদুল আলম সহ সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, এলাকার সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ সহ প্রিন্ট ও ইলেকট্রিক মিডিয়ার সংবাদকর্মী উপস্থিত ছিলেন। উদ্ভোধনের পর থেকেই ব্যপক পর্যটকদের আগমন ঘটে এক নজর দেখতে কাঠের সেতুটি। ২০১৯-২০ সাল পর্যন্ত আশুরার বিলের শেখ ফজিলাতুন্নেছা সেতুটি গণমাধ্যমে প্রচার প্রচারণায় ছিল ব্যাপক এগিয়ে। এরপরে নবাবগঞ্জ উপজেলা পরিষদ হতে বার্ষিক উন্নয়ন তহবিল (এডিপি) এর অর্থায়নে সেতু নির্মাণের ব্যয়ভার বহন করা হয়। নবাবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মোঃ আতাউর রহমান জানান, আশুরার বিল দেশের পর্যটকদের ইতমধ্যেই আকৃষ্ট করেছে। উপজেলা পরিষদ থেকে সার্বিক বিষয়ে সহায়তার আশ্বাস জানান তিনি। শুরু হল উন্নয়নের অগ্রযাত্রা। দিন যায় জাতীয় উদ্যান সহ বিলের অবকাঠামো উন্নয়নে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ৬০লাখ টাকা বরাদ্দে গড়ে তোলা হয় পর্যটকদের বসার জন্য পৃথক তিনটি স্থানে গোলঘর, অত্যাধুনিক শৌচাগার। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) অর্থয়নে বিলের পূর্বদিকে রাবার ক্রস ড্যাম নির্মাণ করা হয়। এছাড়াও ২০২১ সালে ৬ আসনের সংসদ সদস্য মোঃ শিবলী সাদিকের পরামর্শে ‘‘জোসনা বিলাস’’ নামের ভিআইপি দুটি বিশ্রামাগ্রার নির্মাণ করা হয়। সম্প্রতি সেটিও দেখতে আসেন দিনাজপুর জেলা প্রশাসক খালেদ মোহাম্মাদ জাকী। বিলে নতুন সংযোজন এ বিশ্রামাগার। উপজেলা নির্বাহী অফিসার অনিমেষ সোম জানান, বর্তমানে শরতের ঋতুতে নতুনভাবে সেজেছে আশুরার বিল। এ সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি করতে সংস্কার সহ রং বার্ণিশ করা হয়েছে শেখ ফজিলাতুন্নেছা কাঠের সেতু। আর যোগ হয়েছে ভিআইপি ‘‘জোসনা বিলাস’’ বিশ্রামাগার। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) রেফাউল আজম জানান, দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে হেরিং বন্ড সহ এলজিইডির অর্থায়নে রাস্তা কার্পেটিং সমাপ্ত হয়েছে। বর্তমানে অবশিষ্ট নির্মিত ইটের সলিং রাস্তার উদ্ভোধনও করেন জেলা প্রশাসক।
Leave a Reply