রাজশাহী প্রতিবেদক : বিআরটিসি বাসের বুকিং সহকারী থেকে গত দশ বছরে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন ডাবলু সরকার। তিনি রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ক্ষমতার দাপটে দখল বাণিজ্য করেই এ টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। তার আর্থিক উত্থান রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছে। ডাবলু সরকার রাজশাহী শহরে গড়ে তুলেছেন ১২ তলা আলিশান বাড়ি। তার পরিবারের সদস্যদের দখল বাণিজ্য থেকে সংখ্যালঘু শুরু করে সামাজিক বা পারিবারিকভাবে দুর্বল আওয়ামী লীগ কর্মীরাও রেহাই পাননি। যেন অঘোষিত রাজশাহীর ‘রাজা’র বিরুদ্ধে কারও মুখ খোলার সাহস নেই।
এদিকে, সম্প্রতি রাজশাহীর মুক্তিযোদ্ধারা ডাবলু সরকারের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী ও দুদক চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগে মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারের বাড়িঘর দখল ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন ডাবলু সরকার। অথচ তিনি এখনো বিআরটিসির বাসের বুকিং সহকারি পদে কর্মরত। এসব অভিযোগে প্রেক্ষিতে তার সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক।
তারা জানান, ডাবলু সরকারের বাবা আব্দুর রশিদ সরকার রাজশাহীর কুখ্যাত রাজাকার আবদুস সাত্তার ওরফে টিপুর অন্যতম সহযোগী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, নির্যাতন, অপহরণ ও লুণ্ঠনের অভিযোগে ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এ মামলার চার নম্বর আসামী রশিদ সরকার। আসামীদের বিরুদ্ধে উল্লিখিত অভিযোগের প্রমাণ পায় প্রসিকিউশন টিম। তবে ছয়জনের মধ্যে মনো, মজিবর রহমান, আব্দুর রশিদ সরকার, মুসা ও আবুল হোসেন আগেই মারা গেছেন। বেঁচে আছেন একমাত্র আসামি টিপু সুলতান। গত ১১ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল টিপু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ দেন।
জানা যায়, নগরীর ফুদকিপাড়ায় অ্যাডভোকেট কুনালের বাবার বাড়িটি ছিল সরকারের কাছ থেকে লিজ নেওয়া। এই বাড়িতেই কুনালের জন্ম। পড়াশোনা শেষে তার আইন ব্যবসায় যাওয়া এবং মৃত্যু এই বাড়িটি থেকেই। রাজশাহী নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েই ২০১৬ সালে বাড়িটি দখলে নেন ডাবলু সরকার। আইনজীবী কুনালের পুরো পরিবারকে উচ্ছেদ করে বাড়িটি সংস্কার করে ভাড়াও দিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শহরের একাধিক ব্যক্তি জানান, ডাবলু সরকাররা পাঁচ ভাই। এরা যখন কারও বাড়ি বা জমি দখলের জন্য নজর দেন তখন কৌশল হিসেবে সবদিক থেকেই ওই পরিবারকে বিরক্ত করা শুরু করেন। তৃতীয় কোনো পক্ষকে দিয়ে জমিটি দখলে নিতে ভুয়া মামলা বা হুমকি দেওয়া শুরু করেন। এক পর্যায়ে তারা নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার অথবা তার বড় ভাই ২২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল হামিদ সরকার টেকনের শরণাপন্ন হন। এরপর তারা হুমকি-ধমকি দিয়ে নামমাত্র মূল্যে জমিটি রেজিস্ট্রি করে নেন।
জানা যায়, রাজশাহীর পুঁথিঘর লাইব্রেরির মালিক শক্তিভূতির বাড়িটি ছিল বোয়ালিয়া থানার মোড়ে। বাড়ির সামনে বড়পূজাও হতো প্রতি বছর। এই বাড়ি ও পেছনের জমি নামমাত্র মূল্যে ভাগ্নে মীর ইশতিয়াক আহমেদ লেমনের সঙ্গে শেয়ারে রেজিস্ট্রি করে নেন ডাবলু সরকার।
স্থানীয়রা জানান, নগরীর কুমারপাড়া, আলুপট্টি এলাকা ছাড়াও অসংখ্য জায়গা দখলে নিয়েছেন ডাবলু সরকার ও তার পরিবারের সদস্য। নগরীর কুমারপাড়া কালিবাড়ীর সামনে এক নিঃসন্তান শিক্ষকের জমি দখল করে ঘেরাও করে রেখেছেন ডাবলু সরকার। সেখানে বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী রাখা হয়েছে। নিঃসন্তান ওই শিক্ষক মারা গেছেন দেড় দশক আগে। তার বৃদ্ধা স্ত্রী বা পরিবারের খোঁজ কেউ দিতে পারেননি।
অভিযোগ রয়েছে, দখল বাণিজ্য ও অবৈধ অর্থের মাধ্যমে বিআরটিসি বাসের একসময়ের বুকিং সহকারী ডাবলু সরকার নগরীর কুমারপাড়ায় ১২ তলা উঁচু সরকার টাওয়ার নির্মাণ করেছেন।
স্থানীরা জানান, এই জায়গাটি ছিল সখিনা বোর্ডিং-এর। ১৯৯৬ সালের দিকে সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাসিনা দৌলা জমিটি কিনে নেন। কিন্তু তাকে দখলে নামতে দেননি ডাবলু সরকার ও তার ভাই টেকন সরকার ও সাবু সরকার। পরে হাসিনা দৌলার জমিটি নামমাত্র মূল্যে রেজিস্ট্রি করে নেন ডাবলু সরকার ও তার ভাইয়েরা। এই সখিনা বোর্ডিং-এর পেছনেই ছিল শিবু দাইমা বাড়ি। এই শিবু দাইমার হাতেই কুমারপাড়া, আলুপট্টি এলাকার অধিকাংশ শিশুর জন্ম হয়েছিল। হয়তো বাদ যাননি ডাবলু কিংবা তার ভাইয়েরাও। কিন্তু তার জমিটিও রক্ষা পায়নি ডাবলু সরকারের পরিবার থেকে। তাকে হুমকি দিয়ে নামমাত্র মূল্যে জমিটি রেজিস্ট্রি করে নেন। তার পুত্র খোকনের পরিধেয় টেইলার্স নামের দোকানটিও উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়। এর পাশেই ছিল রাজশাহী বেতারের বেহালা বাধক শিবু দাইমার ভাই রঘুনাথ দাসের বাড়ি। এই বাড়িটিও নামমাত্র মূল্যে আর হুমকি দিয়ে রেজিস্ট্রি করে নেন।
কুমারপাড়ায় ডাবলু সরকারের পৈতৃক বাড়ির পাশে ফাঁকা জায়গাটি ছিল সুগার মিলের এক কর্মচারীর। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বাসিন্দা এই ব্যক্তি তার দুই মেয়েকে নিয়ে বসবাসের জন্য জায়গাটি কিনে ছিলেন। কিন্তু মাত্র দুই বছর আগে জমিটি তারা হুমকি দিয়ে নামমাত্র মূল্যে রেজিস্ট্রি করে নেন। রাজশাহী আওয়ামী লীগের ‘বিশিষ্ট কর্মী’ শাহজাহান মামা। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও তাকে ‘শাহজাহান মামা’ বলেই ডাকেন। তার একখ- জমি পৈতৃক ভিটা তালাইমারীতেই বসবাস। বাড়ির পাশেই কিছুটা খাসজমি। তিন পুরুষ ধরেই জমিটি তাদের পরিবারের ভোগ-দখলে। সেই জমিটি দখলে নিতে রাজশাহী নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার লোক পাঠান। এতে ভীষণ বিরক্ত হন প্রধানমন্ত্রীর প্রিয় শাহজাহান মামা। বিষয়টি তাৎক্ষণিক ফোন করে ওবায়দুল কাদেরকে জানান শাহজাহান মামা। জানান সিটি মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনকেও। এতে শাহজাহান মামার জমিটুকু রক্ষা হলেও ডাবলু সরকার ও তার পরিবারের দখলে অসংখ্য সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবার দেশছাড়া হয়েছে।
সংবাদে উল্লেখিত জায়গাগুলোর রেজিস্ট্রি করে নেওয়ার কথা স্বীকার করে ডাবলু সরকার সাংবাদিকদের বলেন, আমি বুকিং সহকারী হলেও বাসগুলো লিজ নিয়ে চালাই। এছাড়া আমি ধনাঢ্য পরিবারের একমাত্র কন্যাকে বিয়ে করেছি। আমার যত সম্পদ অনেকটাই শ্বশুরবাড়ির।
Leave a Reply