প্রত্যাবাসন তালিকায় থাকা রোহিঙ্গাদের সিআইসি অফিসের কাছে বিক্ষোভ (বাঁয়ে); নয়াপাড়া শালবাগান প্রত্যাবাসনের জন্য প্রস্তুত রাখা ঘর :সংগৃহীত –
অবশেষে নির্ধারিত সময় অনুযায়ী আজ বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হচ্ছে। এ জন্য টেকনাফ থেকে ঘুমধুম ট্রানজিট ঘাট পর্যন্ত নেয়া হয়েছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থা।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় কক্সবাজারে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, আজ সকাল থেকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সূচনার লক্ষ্যে পাঁচটি বাস ও তিনটি ট্রাক থাকবে। যারা মিয়ানমার ফিরবে তাদের মালামাল নিতে এসব পরিবহন ব্যবহার করা হবে। তিনি বলেন, মঙ্গলবার ও বুধবার দুই দিনে ২৩৫ রোহিঙ্গা পরিবারের মতামত নেয়া সম্ভব হয়েছে। এদের মধ্যে যারা রাজি থাকবে তাদের দিয়েই প্রত্যাবাসন শুরু করা হবে। তিনি আরো বলেন, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারেও ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে কক্সবাজারে অবস্থান করছে চীন ও মিয়ানমারের দুইজন প্রতিনিধি।
প্রত্যাবাসন নিয়ে বিক্ষোভ : এক দিকে সরকারের প্রস্তুতি অন্য দিকে রোহিঙ্গাদের নানা দাবিÑ এ নিয়ে অনেকটা অনিশ্চয়তার মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কার্যক্রম চলছে। প্রত্যাবাসনের তালিকায় থাকা রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার পর্বের মাধ্যমে প্রত্যাবাসনের সর্বশেষ ধাপ অতিক্রম করতে ইউএনএইচসিআর এবং শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের কর্মকর্তারা ব্যস্ততম সময় পার করছে। আজ ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসনের প্রাথমিক দিনক্ষণ ঠিক করা হয়েছে। টেকনাফের নয়াপাড়া শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ২৬নং ইনচার্জ খালেদ হোসেন জানান, মঙ্গলবার ও গতকাল বুধবার ১০৫ পরিবারের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে।
প্রত্যাবাসন তালিকায় থাকা তিন হাজার ৪৫০ জনের মধ্যে কয়েকজন রোহিঙ্গার সাথে কথা বলতে গেলে নুর হাশেম (৩২) অনেক ভয়ে কথা বলা শুরু করেন। তিনি বলেন, তাদের কিছু শর্ত রয়েছেÑ যা মানলে তারা মিয়ানমারে ফেরত যেতে রাজি। অন্যথায় তারা ফিরবে না। এমনকি গুলি করে মেরে ফেললেও তারা শর্তপূরণ ছাড়া ফিরতে রাজি নয়। এনভিসি কার্ড নয় সরাসরি নাগরিকত্ব প্রদান, ভিটেবাড়ি ও জমিজমা ফেরত, আকিয়াব জেলায় আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের নিজ বাড়িতে ফেরত, কারাগারে বন্দী রোহিঙ্গাদের মুক্তি, হত্যা, ধর্ষণের বিচার, অবাধ চলাফেরা, নিরাপত্তা প্রদানসহ একাধিক শর্ত পূরণ না হলে স্বদেশ ফিরবে না রোহিঙ্গারা। ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ ও ইউএনএইচসিআরের লোকজন রোহিঙ্গাদের ঘরে ঘরে গিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে ২২ আগস্ট স্বদেশে ফিরে যাওয়ার বার্তা। এ সময় অনেক রোহিঙ্গা ঘর ছেড়ে পালিয়ে যান। আবার অনেকে এসব শর্ত জুড়ে দেন।
প্রত্যাবাসনের তালিকায় থাকা শালবন ক্যাম্পের এ-ব্লকে বসবাসকারী মো: জুবাইর জানান, ইউএনএইচসিআরের একটি প্রতিনিধিদল সকালে এসে পারিবারিক ডাটা কার্ড খুঁজে। প্রত্যাবাসনের বিষয়ে কিছু জানায়নি। পরে জানতে পারি প্রত্যাবাসনের তালিকায় আমার নাম রয়েছে। মিয়ানমারের বুচিডং চাংচিপ্রাং এলাকার জোবাইর স্বদেশ ফিরবে কি না প্রশ্নের উত্তরে কয়েকটি শর্ত জুড়ে দিয়ে বলেন, নিজের দেশে ফিরতে ব্যাকুল হয়ে আছি। নাগরিকত্ব, ভিটেবাড়ি ও জমিজমা ফেরত, অবাধ চলাফেরা ও নিরাপত্তা দিলেই ফিরব। এ অবস্থায় গেলে মরণ নিশ্চিত। এর চেয়ে এ দেশে মৃত্যুই ভালো হবে।
তালিকায় থাকা হাসিনা বেগম বলেন, স্বামী-সন্তানদের নিরাপত্তা কে দেবে। ওখানে গিয়ে আশ্রয়শিবিরে রাখবে। অবাধ চলাফেরা করা যাবে না। রোহিঙ্গা স্বীকৃতি দেবে না। তবে কি নিয়ে আমরা স্বদেশ ফিরব।
একই ব্লকের জয়নব বেগম বলেন, মিয়ানমার সরকারকে বিশ্বাস করা যায় না। এর আগেও তারা অনেকবার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। তাই সরাসরি নাগরিকত্ব প্রদান করলেই আমরা ফিরতে পারি।
শালবন ক্যাম্প ডি ব্লকের রোহিঙ্গা মাঝি নুর মোহাম্মদ রোহিঙ্গাদের দাবির সাথে একমত পোষণ করে বলেন, মিয়ানমারে ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীর মতো রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দিতে হবে। পূর্ণ নাগরিকত্ব দিয়ে গোটা মিয়ানমারে অবাধে চলাফেরার স্বাধীনতা দিতে হবে।
এ দিকে প্রত্যাবাসনের তালিকায় থাকা কিছু রোহিঙ্গা মঙ্গলবার ও বুধবার ২৬ নং ক্যাম্পের সিআইসি (ক্যাম্প ইনচার্জ) অফিসের কাছে বিক্ষোভ করেছেন। এ সময় নিজেদের দাবি তুলে ধরে বেশ কিছুক্ষণ বিক্ষোভ করেন রোহিঙ্গারা। বিক্ষোভে অংশ নেয়া মোস্তফা কামাল, শফিকা একই শর্ত জুড়ে দেন।
আবার সাধারণ রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ জানান, ক্যাম্পে তারা স্বাধীন মতামত দিতে পারছেন না। রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপ সব সময় তাদের ওপর নজরদারি করে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এগিয়ে নিতে ইউএনএইচসিআর ও সরকারের পক্ষ থেকে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের কাছে লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। লিফলেটে স্বদেশ ফিরে গিয়ে কোথায়, কিভাবে রাখা হবে এবং পরবর্তীতে কী কী করণীয় সে সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়েছে।
প্রত্যাবাসনের জন্য টেকনাফের কেরনতলী ও নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমে দু’টি ট্রানজিট ঘাট আগেই তৈরি করা ছিল। বাকি ছিল তালিকায় থাকা রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার পর্ব তথা মতামত নেয়া। মঙ্গলবার থেকে রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার নেয়ার মাধ্যমে প্রত্যাবাসনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু করে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। এ সময় জাতিসঙ্ঘ শরণার্থী হাইকমিশনের কর্মকর্তারা প্রথমে তালিকায় থাকা রোহিঙ্গাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মিয়ানমার সরকারের তাদের ফিরিয়ে নেয়ার বার্তা দিয়ে আসছে। পরে তাদের সংশ্লিষ্ট সিআইসি অফিসে নিয়ে এসে সাক্ষাৎকার তথা মতামত নিচ্ছে। এ সময় সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও উপস্থিত থাকছেন। কিন্তু সাক্ষাৎকার পর্ব থেকে বের হয়েই রোহিঙ্গারা জটলা তৈরি করে প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে নানা দাবি জুড়ে দিচ্ছেন। তাদের দাবি পূরণ না হলে মিয়ানমারে ফিরে যাবেন না বলে জানাচ্ছেন তারা। তবে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আশাবাদী শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আরআরআরসি।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম জানান, প্রত্যাবাসন কার্যক্রমের জন্য সব প্রস্তুতি রয়েছে। আমরা আশাবাদী ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসন হবে। পাশাপাশি সকাল থেকে ইউএনএইচসিআরের লোকজন তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছে এবং এসব লোকজনকে সংশ্লিষ্টরা নানাভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। গত বছরের ১৫ নভেম্বর প্রথমদফা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ধার্য দিন রোহিঙ্গাদের অনিচ্ছার কারণে প্রত্যাবাসন করা যায়নি। তবে এবার রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার পর্বে অংশ নেয়াই বুঝিয়ে দিচ্ছে তারা এখন আগের চেয়ে অনেক ইতিবাচক। এমন মন্তব্য শরণার্থী কমিশনারের।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট রাখাইনের ৩০টি নিরাপত্তা চৌকিতে একযোগে হামলার ঘটনা ঘটে। প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন শুরু করে। ফলে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। পুরনোসহ উখিয়া-টেকনাফের ৩০টি শিবিরে এখন ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। তবে জাতিসঙ্ঘের তথ্য অনুযায়ী, এই সংখ্যা ১১ লাখ ৮৫ হাজার ৫৫৭। তাদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি।
Leave a Reply