ছাত্রলীগের টর্চার সেলে আমার একদিন
মারুফ হাসান
দিনটি ছিল ২১ জুলাই ২০১৯, মাস্টার্সের ভর্তি সংক্রান্ত কাজে সকাল ১১ টা নাগাদ ক্যাম্পাসে গিয়েছিলাম।
ভিসি অফিসের সামনে কাজ করা অবস্থায় কথিত ছাত্রলীগ নেতা রবিউল ইসলাম (ইবি ৪র্থ ব্যাচ, EB141008) আমাকে ডাকে।
“তোমার সাথে কথা আছে” ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ভাই ডেকেছে তাই সরল মনে তার সাথে হেটে চলা। কথা বলতে বলতে আমাকে সেন্ট্রাল ক্যাফেটেরিয়ার দ্বিতীয় তলায় ছাত্রলীগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দ দেয়া অফিসের পাশে একটা ছোট্ট কক্ষে নিয়ে যায় (সেটা ওদের অঘোষিত টর্চার সেল)।
আমাকে ডেকে নেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর, ডিপার্টমেন্ট চেয়ারম্যানসহ অনেকেই ওদের কে কল করে রিকোয়েস্ট করেন, যেন তারা আমাকে টর্চার না করে।
প্রায় বিশ মিনিট ধরে নানান ধরনের প্রশ্ন করতে থাকে, কেন সরকারের সমালোচনা করে পোস্ট করি! কেন ভার্সিটির গ্রুপে পোস্ট করি – এইসব।
কথা বলার এক পর্যায়ে পিছন থেকে একজন জঙ্গি কই, জঙ্গি কই বলতে বলতে এসে মারতে শুরু করে তার সাথে উচু মার্মা (আইন বিভাগ), হাসান হাবিব মুরাদ( আইন বিভাগ), তানভীর, ফাহিম, আনাস সহ ৮-১০ জন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী। উপর্যুপুরি মারতে থাকে।
একটা সময় মাথাটা নীচু করে যাস্ট শুয়ে থাকি। ওরা আটজন আমাকে নীচে ফেলে বেদম লাথি কিল ঘুষি… শুধু আল্লাহকে ডাকছিলাম আর আমার মায়ের কথা মনে পড়ছিল। এই অবস্থা আমার মা দেখলে কি করতেন। মা জানলে কি হবে এই ভয়ে মনটা মুচড়ে উঠছিল।
নিচে সহকারী প্রক্টর স্যার দাড়িয়ে থাকায় বেশ কিছুক্ষণ মারার পর নিজেরা আমার শরীরে রক্ত মুছে দিয়ে বলে, চোখ কেন ফুলছে?
আমি বললাম, এমনে ব্যথা পাইসি। আমাকে এটাই বলার জন্য জিজ্ঞেস করা হইসিল।
বলে রাখা প্রয়োজন, সেখানে সেমুহুর্তে ছাত্রলীগের কোটায় নিয়োগ প্রাপ্ত আইআইইউসি-এর স্টাফ আবু নাচের জুয়েল এবং বহিষ্কৃত রব্বানীর দেয়া ছাত্রলীগের বিতর্কিত কমিটি সেক্রেটারি ডলার উপস্থিত ছিল।
নিচে পাঠায় আর যাওয়ার আগে হুমকি দেয় কেউকে কিচ্ছু বললে আরো সমস্যা বাড়বে। চোখ ফোলে লাল হয়ে যাওয়ায় চোখে কাল চশমা পরিয়ে দেওয়া হয়। সহকারী প্রক্টর স্যার আমাকে দেখে চিকিৎসার জন্য মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যেতে চাইলে তারা স্যারের সামনে আমাকে বাইকে তুলে ভার্সিটির মেইন গেইটে তাদের মেসে নিয়ে আসে।
ওখানে আসার পর আমার মোবাইল, মানি ব্যাগ চেক করে। আমার মানি ব্যাগ থেকে টাকা নিয়ে ওদের সিগারেট আর নাস্তার বিল দেয়।
সেখানে অনেক্ষণ জেরা করার পর কাউকে কিছু না জানানোর শর্তে আমাকে ছেড়ে দেয়।
আমি শহরের আবাসিক হলে থাকতাম। সেখানে তাদের চেলা চামচারা আমি কি করছি খবর পাঠাচ্ছিল। হলের সিনিয়র ভাইদের চাপ দিচ্ছিল আমাকে যেন বের করে দেয়া হয়!
হাসপাতালে সাময়িক ট্রিটমেন্ট করে বাড়ি ফিরি। লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেও পারিনি মায়ের কাছে। আমাকে দেখেই বুঝে ফেলেন।
সেই হৃদয় বিদারক স্মৃতি মনে পড়লে এখনো চোখ ভিজে যায়। টলটলে চোখে চারদিক ঝাপসা হয়ে উঠে।
এরপর ভর্তি ক্যান্সেল করে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে আসি। ক্যাম্পাসে কোন দিন রাজনীতি না করার পরও শুধু মাত্র ফেইসবুক পোস্টের কারণে তারা আমাকে টর্চার করেছে।
আমারও দেশপ্রেম আছে তাই দেশের পক্ষে লিখতে চাই। আর ভবিষ্যতে কোন দিন এমন লেখার কারণে আমার মা’ও সন্তান হারা হতে পারে সেই ভয় থেকেই ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে আসা।
আসার পর শুনি আরো ২ জনের সাথে এমন হয়েছে। একজন আমার ডিপার্টমেন্ট এর বড় ভাই, ওনাকে মেরে মোবাইল নিয়ে নিছে আর ফার্মেসির জিতু কে মেরে ১৭ হাজার টাকা নিয়েছে। সব স্যারদের সামনেই হয়েছে। স্যাররা সব জানেন। আমি ছিলাম ২২ তম। ক্যাম্পাস দখলের ৬ মাসে অসংখ্য জানা অজানা এমন ঘটনা ঘটেছিল.. ঘটছে… ঘটবে হয়তো…
আল্লাহ হায়াত রেখেছেন বলে আজও বেঁচে আছি…
Leave a Reply