এই দুর্ঘটনায় বর-কনে, পিতা-পুত্রসহ ১১ জন নিহত হন। – ছবি: সংগৃহীত
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার সলপে ট্রেনের ধাক্কায় বরযাত্রী বহনকারী মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় বর-কনে ও পিতা-পুত্রসহ নিহত ১১ জনের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। বিয়ের আনন্দ পরিণত হয়েছে নিষ্ঠুর বিষাদে। একমাত্র ছেলের বউকে ঘরে তুলে সংসার আলোকিত করার ইচ্ছে পূরণ হলো না আলতাফ হোসেনের। একই সাথে মেয়ে সুমাইয়াকে বিয়ের মাধ্যমে চিরবিদায় দেয়ার মুহূর্ত যেন আর কোনো পরিবারের সামনে না আসে সেটাই চান এলাকাবাসী।
সরেজমিনে জানা যায়, মঙ্গলবার ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে নিহত বর রাজনকে একনজর দেখার জন্য এবং পরিবারকে সান্ত¡না দিতে দূর-দূরান্ত থেকে হাজারও মানুষ ভিড় জমায়। রাজনের বাবা আলতাফ হোসেন উঠোনের মাঝে সন্তানের লাশ সামনে নিয়ে বসে আছেন নির্বাক। ফ্যাল ফ্যাল তাকিয়ে রয়েছেন যেন তার বাড়িতে কিছু একটা হয়েছে। রাজনের মা থেকে থেকে চিৎকার দিয়ে গড়াগড়ি করে যাচ্ছেন। মা বারবার কফিনে ঝাঁপ দিয়ে ছেলের মুখে হাত বুলানোর চেষ্টা করলে পাড়া-পড়শিরা তাকে সামলে নেয়ার জন্য চেষ্টা করছেন।
এই ঘটনায় বর রাজনের ফুফা ও ফুফাতো ভাই, বড় বোন জামাই, বন্ধু-বান্ধবসহ আত্মীয়-স্বজন মারা গেছেন। নিহতরা পরস্পর আত্মীয় এবং তাদের বাড়িও আশপাশ এলাকার হওয়ায় মানুষের আবেগটাও ছিল অন্য রকম। একটু সহানুভূতি জানাতে রাতে ছুটে গিয়েছিল হাসপাতালে। সকালের কাক ডাকা ভোরেও ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো।
এই ঘটনায় মারা যায় পিতা-পুত্র সামাদ ও সাকিল। সামাদ বর রাজনের ফুফা আর সাকিল ফুফাত ভাই। সিরাজগঞ্জ সদরের রামগাঁতি গ্রামে নিহত পিতা-পুত্রের বাড়িতে আশপাশের হাজারো মানুষ এসে ভিড় জমায় বাদ ফজর থেকেই। স্বামী ও সন্তানকে হারিয়ে বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন সাকিলের মা। সাকিলের মায়ের চোখের পানি দেখে উপস্থিত লোকজন অঝর নয়নে কেঁদেছেন এবং বলছেন এমন মৃত্যু যেন আর কাউকে দেখতে না হয়।
বাপের বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়িতে যাওয়ার জন্য বিদায়টা যেন শেষ বিদায় ছিল না সুমাইয়ার। তাইতো শেষ বিদায় নিতে রাতেই তাকে ফিরতে হলো বাপের বাড়িতে। তবে এই বিদায় শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার জন্য নয়; চির বিদায় নিয়ে ওপারে চলে যাওয়ার জন্য। হৈ-হুল্লোর করে বিয়ের পিঁড়িতে বসা সুমাইয়ার কপালে সুখ সইলো না। সুমাইয়ার মা ও বাবা মেয়েকে খুশির দিনে এভাবে হারাবে তা যেন ভাবেনি কেউ।
উল্লাপাড়ার চর ঘাটিনা গ্রামে নতুন বিয়ে বাড়িতে বিষাদের আবহে নির্বাক সবাই। মানুষ এসেছে, ভীড় করছে তবে চোখ ছলছল, টপটপ জলে নয়ন গড়িয়ে বদন মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরছে সবাই। বলছে এ কষ্ট স্মরণ থাকবে অনেকদিন।
এই ঘটনায় সুমাইয়ার বড় বোন জামাই শরীফও মারা গেছেন। শরীফের বাড়ি শহরের দিয়ারধানগড়াতে। সে বাড়িতেও ভোরে তিল ধারনের ঠাঁই নেই। সবাই এসেছে শরীফকে এক নজর দেখতে। শরীফের শিশুকন্যা বাবার বুকে মাথা রেখে ডাকছে, কিন্তু বাবা সাড়া দিচ্ছেন না।
রাজনের কয়েকজন বন্ধু মারা গেছে এই ঘটনায়। তাদের অন্যান্য বন্ধুরা রাতে ছুটে এসেছে সদর হাসপাতালে। সারা রাত দৌড়াদৌড়ির অন্ত ছিল না লাশ খোঁজা ও সনাক্তকরণে। সকালে এসেছে তারা দাফন কার্য সম্পন্ন করতে। বন্ধু বন্ধুকে হারিয়ে হতবিহবল। কারো মুখে কোনো কথা নেই।
সোমবার সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় সলপ স্টেশনের অদূরে পঞ্চক্রোশী রেক্রসিংয়ে নির্মম এই দুর্ঘটনায় বর-কনে, পিতা-পুত্রসহ ১১ জন নিহত হন। নিহতরা হলেন, সদর উপজেলার কালিয়া কান্দাপাড়া গ্রামের আলতাফ হোসেনের ছেলে (বর) রাজন সেখ, উল্লাপাড়া উপজেলার মৃত গফুর সেখের মেয়ে সুমাইয়া খাতুন (কনে) সুমাইয়ার বোন জামাই সিরাজগঞ্জ শহরের দিয়ারধানগড়া গ্রামের শরীফ, সয়াধানগড়া গ্রামের সুরত আলীর ছেলে আহাদ আলী, রায়পুর গ্রামের মুছার ছেলে এবং রাজনের ভগ্নিপতি সুমন, রাজনের ফুফা রামগাতির সামাদ ও ফুফাতো ভাই সামাদের ছেলে সাকিল, আত্মীয় কামারখন্দের কৃঞ্চদিয়ার গ্রামের আলমের ছেলে খোকন, চুনিয়াহাটি গ্রামের মহির উদ্দিনের ছেলে ভাষা সেখ, কান্দাপাড়া গ্রামের শামীমের ছেলে বায়েজীদ ওরফে আলীক ও জামলৈ গ্রামের মাইক্রো চালক স্বাধীন।
এই ঘটনায় পশ্চিমাঞ্চলীয় পাকশী রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ চার সদস্যের একটি তদন্ত টিম গঠন করেছে। কমিটিকে আগামী তিন দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। নিহতদের প্রত্যেককে ২৫ হাজার করে টাকা এবং আহতদের প্রতিজনকে ১০ হাজার করে টাকা অনুদান দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। স্ব-স্ব উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে এই টাকা গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে।
সোমবার দুপুরে সদর উপজেলার কালিয়া কান্দাপাড়া গ্রাম থেকে একটি মাইক্রোবাস বরযাত্রী নিয়ে উল্লাপাড়া উপজেলার চর ঘাটিনা গ্রামে গিয়েছিল। বিয়ে শেষ করে কনে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে মাইক্রোবাসটি উল্লাপাড়া-ঢাকা রেলপথের সলপ অরক্ষিত রেল ক্রসিং অতিক্রম করার সময় রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেনের সাথে সংঘর্ষ হয়। এতে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে।
Leave a Reply