ছবি তুলে কেড়ে নেয়া হয় ত্রাণ; চাল আত্মসাৎ জনপ্রতিনিধিদের; ত্রাণের দাবিতে বিক্ষোভ
করোনা পরিস্থিতিতে কর্মহীন হয়ে পড়া দিনমজুর, দরিদ্র ও নি¤œআয়ের মানুষের জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। বিনা মূল্যে ত্রাণ বিতরণ ছাড়াও সারা দেশে শুরু হয়েছে ১০ টাকা কেজি দরের চাল বিতরণ। এছাড়া অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন পেশার মানুষের জন্য নেয়া হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পদক্ষেপ। কিন্তু সরকারের এসব সুবিধা উপযুক্ত মানুষের মধ্যে বণ্টনে দেখা দিয়েছে নানা অনিয়ম ও সমন্বয়হীনতা। ত্রাণ না পেয়ে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভের ঘটনাও ঘটেছে। বিতরণকালে মানা হচ্ছে না শারীরিক দূরুত্ব। ফলে ত্রাণ বিতরণের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে করোনা সংক্রমণ। দুর্নীতি সহ্য করা হবে না বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হুঁশিয়ারি দেয়ার পরও গত কয়েক দিন দেশের বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণের চাল চুরি করছেন ডিলারসহ জনপ্রতিনিধিরা। এমন অভিযোগ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
ছবি তুলে কেড়ে নেয়া হলো ত্রাণ : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত রোববার বিকেলে ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ উপজেলার বলিদাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে দুখী মানুষের ত্রাণ দেয়ার জন্য ডাকা হয়। পৌরসভার গাড়িতে করে এসব ত্রাণ নিয়ে আসা হয়। এ সময় অসহায়দের ফাঁকা ফাঁকা হয়ে দাঁড়াতে বলা হয়। কিছুক্ষণ পর স্থানীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার, ইউএনও সুবর্ণা রানী সাহা এবং পৌর মেয়র আশরাফুল আলম আশরাফ ত্রাণ বিতরণ করতে মাঠে আসেন। এর পর তাদের সামনে দেয়া হয় ত্রাণের প্যাকেট। ত্রাণ বিতরণের ছবিও তোলা হয়। ত্রাণ বিতরণ শেষে মাগরিবের আজান দেয়ায় স্থানীয় সংসদ সদস্য ও পৌর মেয়র বিদ্যালয় মাঠ ত্যাগ করেন। সাথে ইউএনও চলে যান। এর পর অসহায় কিছু ব্যক্তিকে বলা হয়, আপনাদের নাম তালিকায় নেই। এই বলে তাদের কাছ থেকে ত্রাণের প্যাকেট কেড়ে নেন বলিদাপাড়ার যুবলীগ নেতা সমীর হোসেন ও বাবরা গ্রামের লিটন আলী। একই ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামে হাটহাজারিতে। সেখানকার এক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ত্রাণ দেয়ার ছবি তুলে পরে তা কেড়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। গত ৬ এপ্রিল ওই উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়ন পরিষদ প্রাঙ্গণে এই ঘটনা ঘটে। অসহায় পরিবারগুলোর দাবি, মির্জাপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল আবছার তাদের ত্রাণ দেয়ার জন্য ডেকে নিয়ে ছবি তুলে ত্রাণ কেড়ে নেন। এই ঘটনার প্রতিবাদ করায় চেয়ারম্যান ও তার লোকজন তাদের মারধর করেন।
এ দিকে এ ঘটনায় অভিযুক্ত চেয়ারম্যানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। কারণ দর্শানোর নোটিশে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা কেন হয়েছে, কে বা কারা এ ঘটনার জন্য দায়ী এ বিষয়ে বক্তব্য প্রদান করার জন্য চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ত্রাণের চাল আত্মসাৎ জনপ্রতিনিধিদের : দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারের দেয়া ত্রাণের চাল আত্মসাৎ করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ডিলাররা। এসব ঘটনায় হাতেনাতে গ্রেফতার হয়েছেন বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধি। ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কয়েকজন সাংবাদিক। হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে গত বুধবার আউশকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুহিবুর রহমান হারুন তিন সাংবাদিককে মারধর করেন। গত মঙ্গলবার ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় সাংবাদিক নির্যাতন করে পরদিন গ্রেফতার হন বড় মানিকা ইউপি চেয়ারম্যান জসিম হায়দারের ছেলে নাবিল হায়দার। আর নওগাঁর রানীনগর উপজেলায় আওয়ামী লীগ নেতা আয়েত আলীর গুদাম থেকে ভিজিডির ১৩৮ বস্তা চাল উদ্ধার করা হয় গত বৃহস্পতিবার।
ত্রাণ না পেয়ে সড়ক অবরোধ : ত্রাণ না পেয়ে নীলফামারীর সৈয়দপুরে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন কর্মহীন লোকজন। গত মঙ্গলবার বিকেলে উপজেলার ঢেলাপী উত্তরা আবাসনের সৈয়দপুর-নীলফামারী সড়ক অবরোধ করেন তারা।
স্থানীয় পৌরসভার মেয়র আমজাদ হোসেন সরকার ব্র্যাকের সহযোগিতায় ২৫০টি পরিবারকে ১৫০০ টাকা করে সহযোগিতা করেছেন। বাকি পরিবারগুলো পৌরসভা, উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের পক্ষে কোনো ত্রাণ পায়নি। এতে তারা চরম দুরবস্থায় পড়েছে।
মঙ্গলবার তারা সন্ধ্যায় ওই সড়ক ১ ঘণ্টা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে উপজেলা প্রশাসনসহ জেলা প্রশাসনকে অবহিত করে বিষয়টি সুরাহার আশ্বাস দেয়। এতে বিক্ষোভকারীরা অবরোধ তুলে নেয়।
মনিটরিংয়ে ৫৩ কর্মকর্তা : ত্রাণ কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য ৫৩ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। তারা বিভাগ ও জেলাওয়ারি ত্রাণ কার্যক্রম তদারকি করবেন। দায়িত্বপ্রাপ্তরা সবাই অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব ও উপসচিব পদমর্যাদার।
কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপের মাধ্যমে ত্রাণ কার্যক্রম মনিটরিং করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় কেন্দ্রে (এনডিআরসিসি) প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি কর্মহীনদের তাৎক্ষণিক মানবিক সহায়তা দিতে দেশের ৬৪ জেলায় চার দফায় ২২ কোটি ১৫ লাখ ৭২ হাজার ২৬৪ টাকা এবং ৫৬ হাজার ৫৬৭ টন চাল বরাদ্দ দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
মানা হচ্ছে না শারীরিক দূরত্ব : এ দিকে ত্রাণ বিতরণে মানা হচ্ছে না নিরাপদ দূরত্ব। সারা দেশে নিরাপদ দূরত্ব নিশ্চিত করতে কাজ করছে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু এত কিছুর পরও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছে না অনেকেই। ত্রাণ নেয়া, টিসিবি থেকে পণ্য কেনা ও ১০ টাকা কেজির চাল বিক্রিতে মানা হচ্ছে না সামাজিক দূরত্ব। রীতিমতো ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে কার আগে কে চাল নেবে সেই চেষ্টা চলছে। সংশ্লিষ্টরা বারবার বলার পরেও ব্যর্থ হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা।
জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শাহ কামাল বলেন, ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দেয়া কোনো চাল আত্মসাতের অভিযোগ পাইনি। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে চাল বিতরণ চলছে। এগুলো মন্ত্রণালয় থেকে শক্তভাবে মনিটর করা হচ্ছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খাতুন নয়া দিগন্তকে বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে স্বল্প আয়ের মানুষের সুবিধার কথা বিবেচনা করে বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে চাল দেয়া হয়েছে। এর সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এর পরেও যে ঘটনাগুলো ঘটছে সেগুলোর জন্য জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হচ্ছে।
সূত্রঃ নয়া দিগন্ত
Leave a Reply