মিজানুর রহমান আজহারি
‘আমি যদি এটা করতাম তা হলে আর এমনটা হতো না’। এই জাতীয় কথা এলে মুনাফিকরা বলেÑ আমরা পবিত্র কুরআনে দেখতে পাই, সাহাবীরা যখন যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে যেতেন তখন মুনাফিকরা বলতেন কেন তারা জিহাদে গিয়েছিল। তারা যদি আমাদের সাথে লুকিয়ে থাকত, তাহলে তো আজকে জীবন দিতে হতো না। আসলে আল্লাহ যেটা ফয়সালা করে রেখেছেন, মুমিনদের জন্য সেটাই উত্তম। রাতে ঘুমানোর আগে দরজা বন্ধ করতে বলা হয়েছে, বাতি নিভানোর কথা বলা হয়েছে। তারপর আল্লাহর ওপর ভরসা করতে হবে।
হজরত ওমর ফারুক রা: যখন খলিফা ছিলেন, তখনকার একটি ঘটনার কথা স্মরণ করা যায়। তার সময়ে একদল লোক শুধু মসজিদে থাকতেন। বাইরে গিয়ে কোনো কাজ করতেন না। তিনি তখন তাদেরকে বললেন, তোমরা কারা। এখানে একসাথে বসে আছো কেন। কোনো কাজ নেই তোমাদের। কোনো পেশা নেই। তারা তখন বলেছিল, আমরা আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করছি। তিনিই আমাদের খাবার জোগাবেন। খলিফা ওমর রা: বলেছিলেন, তোমরা তোমাদের কাজ করো, তারপর আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করো। অন্যের ওপর ভরসা করো না।
তার মানে আগে আপনাকে শস্য রোপণ করতে হবে, যতœ নিতে হবে, ফসল তুলতে হবে। নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। তারপর ফলাফলের জন্য আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করতে হবে। এসব থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারি, সাবধানতা অবলম্বন করাÑ এটা তাওয়াক্কুলেরই একটি অংশ।
আল্লাহর ওপর ভরসা রাখাÑ এটা হচ্ছে সেকেন্ড স্টেপ। এই বিষয়টাকে যদি আমরা আরো স্পষ্ট করতে চাই, তাহলে আরো একটি চমৎকার উদাহরণ টানা যেতে পারে। তিরমিজি শরিফের হাদিসÑ রাসূল সা: পাখিকে মডেল হিসেবে ধরে এটি বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা যদি সঠিক পন্থায় আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করতে চাও, তা হলে পাখিদের অনুসরণ করো। প্রতিদিন সকালে পাখিরা শূন্য পেটে খাবারের সন্ধান করে এবং নিজের চেষ্টায় খাবার অন্বেষণ করে ক্ষুধা নিবারণ করে। তারপর সন্ধ্যাবেলায় নিজেদের নীড়ে ফিরে। তারা আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে ঠিকই এবং নিজেদের চেষ্টা তারা চালিয়ে যায়। সকালে কোনো পাখি তার বাসায় বসে থাকে না। নিজের খাবারের সন্ধান করার জন্য নীড় থেকে বের হয়। তারা শহর থেকে মরুভূমিতে ছুটে বেড়ায় এবং খাবারের সন্ধান করে। আল্লাহ লাখ লাখ পাখির সবার খাবারই দেন। কাউকে না খাইয়ে রাখেন না। কিন্তু তারা তাদের চেষ্টা চালিয়ে যায়।’ ইসলামে তাওয়াক্কুল করার বিধি পাখিদের এই উদাহরণ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়। এই উদাহরণ থেকে আমরা বুঝতে পারলাম, আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করে যেতে হবে। তারপর তাওয়াক্কুল করতে হবে আল্লাহর ওপর।
সূরাতুল রা’ধের ১১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘আল্লাহর সাহায্যের প্রধানতম শর্ত হচ্ছে চেষ্টা করা। আল্লাহতায়ালা ততক্ষণ পর্যন্ত একটা জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন ঘপ্রণ না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই জাতি তার নিজের ভাগ্য নিজে পরিবর্তন করে। নিজের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য আগে নিজেদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। তারপর ভরসা করতে হবে আল্লাহর ওপর।
সর্বশেষ আমরা জানব, আল্লাহর রাসূল সা: কিভাবে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করতেন। তিনি তার জীবনে বিভিন্ন উপায় এবং বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছেন। কৌশলগুলো তিনি বৈধভাবে, বৈধ উপায়ে করেছেন। যেমনÑ তার হিজরতের ঘটনা থেকে জানা যায়, রাতের অন্ধকারে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি হজরত আবু বকর রা:কে সাথে নিয়ে মক্কা থেকে বের হয়েছিলেন। তিনি তো দিনের বেলায় বের হননি। এটা তার সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করার একটি উদাহরণ। মক্কা থেকে মদিনা উত্তর দিকে। অথচ তিনি বের হওয়ার সময় দক্ষিণ দিকে রওনা হয়েছিলেন। যাতে কেউ বুঝতে না পারে যে, তিনি মদিনায় চলে যাচ্ছেন। তিনি তো আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে ঘরে বসে থাকেননি। রাতে লোকচক্ষুর অন্তরালে তিনি বের হয়েছিলেন। তিনি মদিনায় হিজরতের সময় স্বাভাবিক পথ ধরে হাঁটেননি। অপরিচিত একটা রুট ব্যবহার করেছিলেন, যে পথ সচরাচর কেউ ব্যবহার করে না। মহানবী সা:-এর আরেকটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যায়। উহুদের যুদ্ধে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেখানে যুদ্ধের ময়দানে তিনি যখন তার তাঁবু থেকে বের হয়ে সেনাবাহিনীকে দিকনির্দেশনা দিতেন, তখন তিনি গায়ে দুটি বর্ম পরিধান করতেন। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিয়ে তিনি যুদ্ধের ময়দানে থাকতেন। তিনি তো তখন বলতে পারতেন, দেখি আল্লাহর শক্তিই বেশি নাকি কাফেরদের শক্তি বেশি। তিনি তা করেননি। তিনি সর্বোচ্চ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়েছেন, তারপর আল্লাহর ওপর তিনি তাওয়াক্কুল করেছেন।
তিনি খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খনন করতে সাহাবিদের নির্দেশ দিয়েছেন। সাহাবিরা যখন ক্ষুধায় পেটে পাথর বেঁধে পরিখা খনন করছিলেন, তখন কোনো এক সাহাবি নবী সা:কে দেখালেন যে, ক্ষুধার যন্ত্রণায় পেটে পাথর বেঁধে তিনি খননকাজ করছেন। এটা দেখানোর পর নবী সা: তার নিজের জামা খুলে দেখালেন। ওই সাহাবি দেখলেনÑ নবী সা:-এর পেটে দুটি পাথর বাঁধা। তিনি তো আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে খননকাজ না করেও থাকতে পারতেন। তা তিনি করেননি। নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন তিনি। তারপর আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করেছেন।
তাওয়াক্কুলের ফল কিন্তু অতি উত্তম। আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করলে মন শান্ত থাকে, মনে প্রশান্তি আসে। যেটাকে বলা হয় পিস অব মাইন্ড। আমরা বলতে পারি, আল্লাহ তো রাজাধিরাজ। তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন। এটাই মুমিনের জন্য পিস অব মাইন্ড, প্রশান্তি। তাই আমাদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
তাওয়াক্কুলের তৃতীয় উপকার হচ্ছে, এটি ইবাদতেরই একটা অংশ। তাওয়াক্কুল আমাদের বিশ্বাসকে আরো মজবুত করে। ঈমান পাকাপোক্ত হয়। তাই, করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু চালিয়ে যাবো। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখব, নিজেদের নিরাপত্তার যথাসাধ্য চেষ্টা করব, ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশনের নির্দেশনা মেনে চলব এবং ঘরে থাকব। আল্লাহর ইবাদত করব, আল্লাহর কাছে পানাহ চাইব। হেলথ এবং হাইজিনের সব নিয়ম-কানুন, বারবার হাত ধোয়া, বেশি বেশি পানি খাওয়া, হাঁচি-কাশি শুদ্ধাচার মেনে চলাÑ এগুলো সবই করব। সেই সাথে মহান আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করব যাতে এই মহা বালামুছিবত থেকে আল্লাহ আমাদের রক্ষা করেন। সেই সাথে গরিবের দিকে সুনজরে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবো। বিপদে দান করলে আল্লাহ বিপদ উঠিয়ে নেন।
ভিডিও ক্লিপ থেকে অনুলিখন
Leave a Reply