‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকো এবং ইনসাফের সাক্ষ্যদাতা হও। কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদের সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে, সুবিচার করবেÑ তা তাকওয়ার সাথে সামঞ্জস্যশীল এবং আল্লাহকে ভয় করবেÑ তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে ওয়কিবহাল’ (সূরা মাইদা : ৮)।
নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের অধিপতি আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঈমানদারদের উদ্দেশ করে বলেছেন, ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে ইনসাফের সাক্ষ্যদাতা হতে। কারো প্রতি শত্রুতাবশত যেন সুবিচার বর্জনে তারা প্ররোচিত না হয়।
আনসারদের বনু জাফর গোত্রের ‘তোমা’ নামের এক ব্যক্তি একজন আনসার সাহাবির লৌহবর্ম চুরি করে এক ইহুদির কাছে গচ্ছিত রেখে তার ওপর চুরির অপবাদ আরোপ করে। তারা মহানবী সা:-এর কাছে তোমা’র মুসলিম হওয়া এবং ইহুদির মুশরিক হওয়ার ভিত্তিতে তোমা’র সাফাই গ্রহণ করে তাকে শাস্তি থেকে রেহাই দেয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে পীড়াপীড়ি করতে থাকে। সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে ইহুদির বিরুদ্ধে রায় দেয়ার আগমুহূর্তে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা রাসূল সা:-এর প্রতি অহি নাজিল করলেন এবং ঘটনার মূল রহস্য তাঁর সামনে তুলে ধরলেন (ইসলামে মানবাধিকার)।
আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! আমরা এই কিতাব পূর্ণ সত্যতাসহকারে তোমার ওপর নাজিল করেছি, যেন আল্লাহ তোমাকে যে সত্যপথ দেখিয়েছেন তদনুসারে তাদের মধ্যে ফায়সালা করে দিতে পারো। তুমি প্রতারক ও দুর্নীতিবাজদের সমর্থনে বিতর্ককারী হয়ো না। তুমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও দয়াময়। যারা নিজেদের সাথে প্রতারণা করে তুমি তাদের সাহায্য করো না। আল্লাহ প্রতারক পাপিষ্ঠদের পছন্দ করেন না। এরা মানুষের কাছ থেকে নিজেদের আপকর্ম লুকাতে পারে কিন্তু আল্লাহর কাছ থেকে লুকাতে পারে না। তিনি তো ঠিক সেই সময়ও তাদের সাথে থাকেন যখন তারা রাতের বেলায় আল্লাহর মর্জির বিরুদ্ধে পরামর্শ করে। এদের সব কাজই আল্লাহর আওতাধীন। হ্যাঁ, তোমরা এসব অপরাধীর পক্ষ সমর্থনে পার্থিব জীবনে খুব তো ঝগড়া করে নিলে কিন্তু কিয়ামতের দিন এদের পক্ষে কে ঝগড়া করবে? কে এদের উকিল হবে? আর যে ব্যক্তি নিজে কোনো পাপ কাজ করে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির ওপর দোষ চাপায় সে মিথ্যা অপবাদ ও পাপের বোঝা বহন করে। হে নবী!
তোমার ওপর আল্লাহ দয়া ও অনুগ্রহ না থাকলে তাদের একদল তোমাকে ভুল ধারণায় নিমজ্জিত করার ফায়সালাই করে ফেলেছিল, যদিও তারা নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে পথভ্রষ্ট করতে পারত না। আল্লাহ তোমার প্রতি কিতাব ও হিকমত নাজিল করেছেন এবং তোমাকে এমন জ্ঞান দান করেছেন যা তোমার জানা ছিল না। তোমার উপর রয়েছে আল্লাহর মহা অনুগ্রহ (সূরা নিসা : ১০৫-১১৩)।
একজন অমুসলিম ইহুদিকে নিরপরাধ ঘোষণা করতে অহি নাজিল করা হলো! আসমান-জমিনের মালিকের দৃষ্টিতে এটি কোনো ছোটখাটো বিষয় ছিল না। তিনি তো জানেন মানবমণ্ডলীর মধ্যে ভবিষ্যতে এমন ধরনের বহু ঘটনা ঘটবে, যার প্রতিরোধের ব্যবস্থা তিনি আসমানি বিধানের মাধ্যমে দিয়ে এই সাবধানবাণী পাঠালেন যে, পার্থিব জীবনে অপরাধীর পক্ষ সমর্থনে তোমরা খুব তো ঝগড়া করে নিলে কিন্তু শেষ বিচারের দিনে সবদর্শী মহান বিচারকের বিচারালয়ে কে তাদের পক্ষে ঝগড়া করবে এবং কে-ই বা তাদের পক্ষে উকিল হয়ে বিতর্কে লিপ্ত হবে? কারণ তাঁর দৃষ্টির আওতাধীন পুরো বিশ্বলোক। তিনি সব ষড়যন্ত্রকারীর গোপন শলাপরামর্শেও শ্রোতা ও দ্রষ্টা।
অপার বিস্ময়ে স্তম্ভিত হতে হয় এই ভেবে যে,উপরিউক্ত আয়াতগুলোর কোথাও কিন্তু আসমান জমিনের একচ্ছত্র অধিপতি আল্লাহ জাল্লাহ শা’নুহু এ কথাটি একটি বারের জন্যও উল্লেখ করেননি তিনি ইহুদির নির্দোষিতার সাক্ষ্য দিয়ে তাকে শাস্তি থেকে রেহাই দিয়ে, তিনি ইহুদির প্রতি কোনো অনুগ্রহ করেছেন? না, আমাদের মহান ‘রব’ তা করেননি, ইহুদির প্রতি সুবিচার করাকে তিনি ইহুদির ন্যায্য অধিকার বলে এ বিষয়টির প্রসঙ্গ উত্থাপন না করে, এটিকে বিচারপতি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা:-এর প্রতি মহা অনুগ্রহ করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন!
আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার দয়া ও মহা অনুগ্রহ না থাকলে তো নবী সা: ভুল ধারণায় নিমজ্জিত হয়ে ইহুদির প্রতি সুবিচার করতে পারতেন না। মহানবী সা: যা কিছু বলেছেন, করেছেন তার সবই সেই মহা সত্তার নির্দেশেই করেছেন। আমরা যদি তৎকালীন সময়ের মহানবী সা:-এর বিচারিক আদালতের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করি তাহলে দেখতে পাবো ‘আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার’ এই বান্দা নিরপেক্ষ বিচার আর সুষ্ঠু তদন্তের প্রতি কতখানি গুরুত্ব আরোপ করতেন।
মানবাধিকার মানুষের অধিকার। এ অধিকার মানবমণ্ডলীর জন্য কতখানি প্রযোজ্য এবং রক্ষিত তার প্রমাণ আমরা ইসলামী জীবনবিধান পবিত্র আল কুরআন এবং রাসূলুল্লাহ সা:-এর বিচারিক আদালতের কার্যবিবরণী থেকে পাই। চলমান বিশ্বে জাতিসঙ্ঘ থেকে মানবাধিকারের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, তার কার্যকারিতা নাকি পুরো বিশ্ব মানবতার জন্য প্রযোজ্য? অথচ আমরা এখানে দেখতে পাচ্ছি এই মানবাধিকার বিশ্বের দিকে দিকে তার সংজ্ঞায় মাঝে মধ্যে রূপ পাল্টায়!! ইসলামে মানবাধিকার সবার ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য।এর ব্যত্যয় ঘটার কোনো অবকাশ নেই। কোনো মুসলমান যদি নিজের খেয়াল খুশির অনুসরণ করে তা কোনোভাবেই ইসলামে প্রযোজ্য হবে না।
জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারবাদীরা তো আর চোখে ঠুলি দিয়ে চলেন না। এ বিষয় নিয়ে বিশ্ব মানবাধিকারবাদীরা তেমন মাথা ঘামান না!! মাঝে মধ্যে রুটিন ওয়ার্ক করেন!! এ ছাড়া আমরা অন্য কিছু ভাবতে পারি না। ব্রিটিশ আমলে শুলক রাজ আনন্দ নামে একজন লেখক একটি বই লিখেছিলেন। যে বইটি লিখে রাজরোষে পড়ে লেখক কারাবরণ করেন। বইটির নাম কুলি। এ বইয়ে লেখক কুলিদের আক্ষেপ এভাবে তুলে ধরেন, ‘হায় ভগবান! তোমার রাজ্যে একমুঠো অন্ন তা এতই দুর্লভ আর মানুষের প্রাণ তা এতই সস্তা।’ ছোটবেলায় পড়লেও উক্তিটি মনে দাগ কেটেছিল বলে আজো মনে আছে!
আমাদের সরকার যদি ঠাণ্ডা মাথায় বসে চিন্তা করতÑ দেশের ভিন্ন মতাবলম্বী মাত্রই তার শত্রু নয়। প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধ গ্রহণের রাজনীতি কোনোকালেই মানবজাতির জন্য সুফল বয়ে আনেনি। সৌহার্দ্য সহমর্মিতা জবাবদিহিতা আর পরস্পর কল্যাণকামিতার মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে কল্যাণকর রাষ্ট্র এবং সরকার। অরাজকতার এই সময় সরকার শুভবুদ্ধির পরিচয় দিলে আত্মঘাতী সঙ্ঘাত এড়ানো সম্ভব হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। জঙ্গি কারা? জঙ্গিবাদের সমর্থক কারা? ইসলামী জীবনধারায় বিশ্বাসী মানবমণ্ডলী কোনো কালেই জঙ্গিবাদের সমর্থক নয়। ঢালাওভাবে ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী মানবমণ্ডলীকে জঙ্গিবাদের সাথে সম্পৃক্ত করা ও চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। দেশ ও জাতির স্বার্থে সরকার কি পারে না, একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্র জনগণকে উপহার দিয়ে নিজেদের সদিচ্ছার প্রমাণ দিতে?
লেখক : প্রবন্ধকার
Leave a Reply