মাওলানা মুহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন:
১৭২ বছর পর বিরল সূর্যগ্রহণ দেখবে বিশ্ব। আজ ২৬ ডিসেম্বর এই সূর্যগ্রহণ সংঘটিত হবে। এ সময় সূর্যের চারপাশে আগুনের বলয় থাকবে। বিজ্ঞানীরা এটিকে ‘রিং অব ফায়ার’ বলেন।
জানা গেছে, আড়াই ঘণ্টা ধরে চলবে এই মহাজাগতিক দৃশ্য। সূর্যের ৯০ শতাংশের বেশি ঢেকে ফেলবে চাঁদ, যা খালি চোখেই অবলোকন করতে পারবেন পৃথিবীবাসী। ইউরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলো থেকে দেখা যাবে এই সূর্যগ্রহণ। তবে এই দৃশ্যটি সবচেয়ে ভালো দেখা যাবে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে।
পূর্ণগ্রাসের সূর্যগ্রহণে হঠাৎ দিনের বেলা রাতের অন্ধকার নেমে আসে। চারপাশের প্রকৃতিতে হঠাৎ একটা পরিবর্তন তৈরি হয়। সন্ধ্যার আভাস পেয়ে পাখিরা বনে ফিরে যেতে থাকে, বাতাস স্থির হয়ে যায় এবং হঠাৎ তাপমাত্রা কমতে থাকে।
চন্দ্রগ্রহণের চেয়ে সূর্যগ্রহণের সংখ্যা বেশি
বিজ্ঞানীরা বলছেন, চন্দ্রগ্রহণের চেয়ে সূর্যগ্রহণ বেশি হয়। প্রতি সাতটি গ্রহণের মধ্যে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের অনুপাত ৫:২ বা ৪:৩।
তবে অধিকাংশ সূর্যগ্রহণ সমুদ্রপৃষ্ঠে বা পর্বতমালার ওপর দিয়ে গেলে নজরে আসে না।
সূর্য ও চন্দ্র প্রতিনিয়ত মহান আল্লাহতায়ালার অস্তিত্বের জানান দেয়। চাঁদের আলোর উৎস হলো সূর্য। এ নক্ষত্রের ব্যাস ১৩ লাখ ৯৪ হাজার কিলোমিটার। এটির সঙ্গে পৃথিবী ও জীবজগতের সম্পর্ক সুনিবিড়। সূর্যের তাপে মহান আল্লাহতায়ালা পৃথিবীর সব কিছু সতেজ-সজীব রেখেছেন। উদ্ভিদ এই সূর্যালোক থেকে খাদ্য গ্রহণ করে।
পৃথিবীতে সূর্যের তাপ ও আলো না এলে প্রাণিকুলের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়বে। সমগ্র পৃথিবী পরিণত হবে একখণ্ড বরফে। অন্যদিকে সূর্য যদি তার ভেতরকার সব তাপ পৃথিবীতে ছেড়ে দিত, তাহলেও পৃথিবী জ¦লে-পুড়ে ভষ্ম হয়ে যেত।
সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণ কী
চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ আল্লাহতায়ালা কর্তৃক নির্ধারিত একটি প্রক্রিয়া। চাঁদ যখন পরিভ্রমণরত অবস্থায় কিছুক্ষণের জন্য পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে এসে পড়ে, তখন পৃথিবীর কোনো দর্শকের কাছে কিছু সময়ের জন্য সূর্য আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যায়। এটাই সূর্যগ্রহণ (ঝড়ষধৎ বপষরঢ়ংব) বা কুসুফ। আর পৃথিবী যখন তার পরিভ্রমণরত অবস্থায় চাঁদ ও সূর্যের মাঝখানে এসে পড়ে, তখনই পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে চাঁদ কিছুক্ষণের জন্য অদৃশ্য হয়ে যায়। এটাই চন্দ্রগ্রহণ (খঁহধৎ বপষরঢ়ংব) বা খুসুফ।
পবিত্র কোরআনে সূর্য ও চন্দ্র প্রসঙ্গ
আমরা বাংলায় সূর্যালোক অথবা চন্দ্রালোক বলি। ইংরেজিতে বলি ঝঁহষরমযঃ এবং গড়ড়হষরমযঃ। কিন্তু পবিত্র কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই সত্তা, যিনি সূর্যকে কিরণোজ্জ্বল ও চঁঁদকে স্নিগ্ধ আলোয় আলোকিত করেছেন। ’ (সুরা ইউনুস, আয়াত : ৫) সূর্য সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আর আমি সৃষ্টি করেছি একটি প্রজ্বলিত বাতি। ’ (সুরা নাবা, আয়াত : ১৩)
চাঁদের ব্যাপারে বিজ্ঞান বলে চাঁদের নিজস্ব কোনো আলো নেই। সূর্যের প্রতিফলিত আলোই চাঁদের সম্বল। পবিত্র কোরআন আরও স্পষ্ট করে বলছে, ‘আল্লাহ চাঁদকে স্থাপন করেছেন আলোরূপে, আর সূর্যকে স্থাপন করেছেন প্রদীপরূপে। ’ (সুরা নুহ, আয়াত: ১৬)
ইসলামের দৃষ্টিতে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ
সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণকে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গিতে এতদুয়ের ওপর একটি ক্রান্তিকাল হিসেবে গণ্য করা হয়। সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহর সৃষ্টি। এর প্রমাণস্বরূপই আল্লাহ এ দুটোর ওপর ‘গ্রহণ’ দান করেন। আর এই দুটি আল্লাহর অপার কুদরতের নিদর্শন বৈ অন্য কিছুই নয়।
হাদিস বিশারদ ও ইসলামের গবেষকরা বলেছেন, সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ আল্লাহর পক্ষ থেকে এ সতর্কবাণী পৌঁছে দেয় যে, অন্যান্য সৃষ্টির মতো চন্দ্র-সূর্যও আল্লাহর মাখলুক; এরা উপাসনার যোগ্য নয়। এ দুটি যেহেতু নিজেরাই বিপদাক্রান্ত হয়, তাই এগুলো উপাসনার যোগ্য হতে পারে না। বরং এ দুটিকে মহান আল্লাহকে চেনার মাধ্যম গ্রহণ করাই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক।
আল্লাহ বলেছেন, ‘তার নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে রাত, দিন, সূর্য ও চন্দ্র। তোমরা সূর্যকে সিজদা কোরো না, আর চন্দ্রকেও না; আল্লাহকে সিজদা করো, যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা নিষ্ঠার সঙ্গে শুধু তারই ইবাদত করে থাকো। ’ (সুরা হা-মিম সিজদা, আয়াত : ৩৭)
জাহিলি যুগে মানুষের ধারণা ছিল, কোনো মহাপুরুষের জন্ম-মৃত্যু বা দুর্যোগ-দুর্ভিক্ষ প্রভৃতির বার্তা দিতে সূর্য বা চন্দ্রগহণ হয়। ইসলাম এটাকে একটি ভ্রান্ত ধারণা আখ্যায়িত করেছে। ‘গ্রহণ’-কে সূর্য ও চন্দ্রের ওপর একটি বিশেষ ক্রান্তিকাল বা বিপদের সময় গণ্য করেছে।
এ কারণে সূর্য বা গ্রহণের সময় মুমিনদের অন্যান্য কাজকর্ম বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, তারা যেন এ সময়ে আল্লাহর তাসবিহ ও পবিত্রতা বর্ণনা করে। দোয়া, নামাজ ও আমল ইত্যাদিতে ব্যস্ত থাকে।
হাদিসের আলোকে সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণ
মুগিরা ইবনু শুবা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.)-এর পুত্র ইবরাহিমের মৃত্যুর দিনটিতেই সূর্যগ্রহণ হয়। তখন আমরা সবাই বলাবলি করছিলাম যে, নবিপুত্রের মৃত্যুর কারণেই এমনটা ঘটেছে। আমাদের কথাবার্তা শুনে রাসুল (সা.) বলেন, ‘সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহর অগণিত নিদর্শনগুলোর মধ্যে দুটি নিদর্শন, কারোর মৃত্যু বা জন্মের ফলে চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ হয় না। ’ (বুখারি, হাদিস : ১০৪৩; মুসলিম, হাদিস : ৯১৫)
আবু বকর (রা.) বর্ণনা করেন, আমরা রাসুল (সা.)-এর কাছে ছিলাম। এমন সময় সূর্যগ্রহণ শুরু হয়। রাসুল (সা.) তখন উঠে দাঁড়ালেন এবং নিজের চাদর টানতে টানতে মসজিদে প্রবেশ করেন। আমরাও প্রবেশ করি। তিনি আমাদের নিয়ে সূর্য প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত দু’রাকাত নামাজ আদায় করেন। এরপর তিনি বলেন, ‘কারও মৃত্যুর কারণে কখনো সূর্যগ্রহণ কিংবা চন্দ্রগ্রহণ হয় না। তোমরা যখন সূর্যগ্রহণ দেখবে তখন এ অবস্থা কেটে যাওয়া পর্যন্ত নামাজ আদায় করবে এবং দোয়া করতে থাকবে। ’ (বুখারি, হাদিস : ৯৮৩)
আবু মুসা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) -এর যুগে সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। তখন তিনি এই আশঙ্কায় উঠে দাঁড়ালেন যে, কিয়ামতের মহাপ্রলয় বুঝি সংঘটিত হবে। তিনি দ্রুত মসজিদে চলে আসেন। এরপর অত্যন্ত দীর্ঘ কিয়াম, দীর্ঘ রুকু ও দীর্ঘ সিজদার সঙ্গে নামাজ আদায় করেন। আমি আর কোনো নামাজে কখনো এমন (দীর্ঘ) দেখিনি। এরপর রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর এসব নিদর্শনাবলি কারও মৃত্যুর কারণে হয় না, কারও জন্মের কারণেও হয় না। তিনি এগুলো প্রেরণ করেন তার বান্দাদের সতর্ক করার জন্য। যখন তোমরা এসব নিদর্শনাবলির কিছু দেখতে পাও তখন তোমরা আতঙ্কিত হৃদয়ে আল্লাহর জিকির-স্মরণ, দোয়া ও ইস্তিগফারে ব্যস্ত হও। (মুসলিম, হাদিস : ১৯৮৯)
Leave a Reply