বরেন্দ্র নিউজ ডেস্ক
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের গণহত্যার বিপরীতে নিজের স্পষ্ট অবস্থানের কারণে বহু আগেই নিজের অর্জিত সম্মান হারিয়েছেন একসময়কার এশিয়ার ম্যান্ডেলা অং সান সু চি। এখনকার রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা সু চি সবশেষ গত বছর ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) নিজ দেশের সেনাবাহিনীর গণহত্যার পক্ষে সাফাই গাইতে হাজির হয়ে নিজের কষ্টার্জিত আন্তর্জাতিক সম্মানের অবশেষটুকুও নষ্ট করেছিলেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, আইসিজে মিয়ানমারকে গণহত্যা মামলায় অভিযুক্ত করার পর সু চি এখন কেবলই একজন ক্ষমতালিপ্সু স্বৈরাচার, যিনি ক্ষমতা ধরে রাখার স্বার্থে নিজ দেশের সামরিক বাহিনীর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের পক্ষে দাঁড়ান। যুক্তরাষ্ট্রের বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের এক বিশ্নেষণে এভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে সু চিকে।
২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর পূর্বপরিকল্পিত সহিংসতা জোরদার করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। হত্যাকান্ড, সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণ এবং ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের বাস্তবতায় জীবন বাঁচাতে নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এই নৃশংসতাকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিয়ে গত ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর জাতিসঙ্ঘের সর্বোচ্চ আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) মামলা করে গাম্বিয়া। গত বছর ডিসেম্বরে ওই মামলার শুনানিতে অংশ নিয়ে সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের পক্ষে সাফাই গান সু চি। বিশ্বপরিসরে সু চি মানবাধিকার হরণের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়েছিলেন যতটা না আদালতে লড়াই করার জন্য, তার থেকে বেশি নিজ দেশে তার জাতীয়তাবাদী গ্রহণযোগ্যতাকে শক্তিশালী করতে।
নিজ দেশের সেনাবাহিনীর পক্ষ নিয়ে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন সু চি। তাতে অবশ্য আদালত প্ররোচিত হননি। রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ঠেকাতে সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে মিয়ানমারকে নির্দেশ দিয়েছেন আইসিজে। সাবেক মার্কিন কংগ্রেস সদস্য এবং জাতিসঙ্ঘ দূত বিল রিচার্ডসন বলেন, আইসিজের অর্ন্তর্র্বতী আদেশের পর সু চি তার সমস্ত মান-সম্মান খুইয়েছেন। গণতন্ত্রের জন্য নোবেলজয়ী থেকে তিনি রূপান্তরিত হয়েছেন একজন স্বৈরশাসকে, যে তার ক্ষমতা ধরে রাখতে সামরিক নিপীড়ন, গণহত্যা ও রোহিঙ্গা নিধনকে বৈধতা দেন।’
জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন রোহিঙ্গা নিধনের ঘটনায় গণহত্যার আলামত পেলেও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী শুরু থেকেই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। সু চিও রোহিঙ্গাদের পক্ষে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা নিতে সক্ষম হননি। বরং গণহত্যাকে আড়াল করার চেষ্টা করেছেন তিনি। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নিতেও কোনো উদ্যোগ নেননি তিনি, উল্টো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থেমে থাকার দায় ঢাকার ওপর চাপিয়েছেন। সবমিলে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সুরক্ষায় তার অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সামরিক শাসনের মিয়ানমারে সু চির অহিংস আন্দোলন চূড়ান্ত সাফল্য পায় ২০১৫ সালে। ওই বছর তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পায়। আশা করা হচ্ছিল এর মাধ্যমে মিয়ানমার গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করবে। তবে বিপরীত ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। ক্রমশ পতনের পথে ধাবিত হতে থাকেন সু চি। পতনের চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো হওয়ার পর।
তার সাবেক ভক্তদের মতে, সু চি কেবল নিজেদের প্রতিরক্ষার পক্ষে কথা বলছেন, রোহিঙ্গাদের রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক সময় সু চির ব্যাপক প্রশংসা করেছিলেন। ওবামা বলেন, বছরের পর বছর ধরে সু চির নিরলস প্রচেষ্টা ও ত্যাগের কারণে মিয়ানমার আরও বেশি শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক হয়েছে।
রোহিঙ্গা ট্র্যাজেডির খবর প্রকাশের পর ১৯৮৪ সালে শান্তিতে নোবেলজয়ী আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু সু চিকে একটি খোলা চিঠি লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন। চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, আমার প্রিয় বোন, জনজীবনে আপনার উত্থান হওয়ার পর রোহিঙ্গা নিপীড়ন প্রশ্নে আমাদের উদ্বেগ প্রশমিত হয়েছিল। কিন্তু এখনও রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধনযজ্ঞ বজায় রয়েছে বলে অভিযোগ করছে কেউ কেউ। ন্যায়পরায়ণতার প্রতীক হিসেবে কোনো ব্যক্তি দেশ পরিচালনা করতে গেলে এ বিষয়গুলো তার কাছে অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হওয়ার কথা। এমন যদি হয় যে, আপনার নীরবতা হলো মিয়ানমারের সর্বোচ্চ পদে অসীন হওয়ার রাজনৈতিক মূল্য চুকানো, তবে নিশ্চিতভাবে বলব, এ মূল্যটা খুব চড়া হবে।
তিনি লিখেছেন, আমরা আপনার জনগণের জন্য ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও ঐক্যের পক্ষে প্রার্থনা করছি। আমরা আপনার হস্তক্ষেপ আশা করছি।
সু চির অবস্থানের নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে মিয়ানমারের রাজনৈতিক বাস্তবতার। নিজ দলের বিশাল বিজয়ের পরও সাংবিধানিক ক্ষমতার প্রশ্নে এখনও দেশের প্রকৃত শাসক সেনাবাহিনী। সামরিক শাসনবিরোধী লড়াইয়ে সু চির মিত্র ছিল লবিং গ্রæপ বার্মা ক্যাম্পেইন ইউকে। তারা মনে করছে, সু চি রোহিঙ্গা নিধনের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন নিজেকে জাতীয়তাবাদী প্রমাণ করে আসন্ন নির্বাচনে তার ভোট বাড়ানোর স্বার্থে। রোহিঙ্গা নিধনের প্রেক্ষাপটে একের পর এক সম্মাননা হারিয়েছেন সু চি।
Leave a Reply